ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

হোমিওপ্যাথির জনক হ্যানিম্যানের ২৫৭ তম জন্মদিন

ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১২
হোমিওপ্যাথির জনক হ্যানিম্যানের ২৫৭ তম জন্মদিন

আজ ১০ এপ্রিল মঙ্গলবার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা রীতির জনক ক্রিশ্চিয়ান ফ্রেডিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ওরফে ডা. হ্যানিম্যানের জন্মদিন। বিশ্বব্যাপী হ্যানিম্যান নামে পরিচিত এই মহাজ্ঞানী পণ্ডিতের এটি ২৫৭ তম জন্মদিন।



হ্যানিম্যান নিজেকে কখনও হোমিওপ্যাথি পদ্ধতির আবিষ্কারক দাবি করেননি। তবে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, হ্যানিম্যানই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সদৃশবিধানের ওপর ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক এ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। প্রচলিত সব চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে এর নীতি ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাই তিনি নিঃসন্দেহে প্রচলিত হোমিওপ্যাথির জনক।

প্রায় চার শতাব্দী পূর্বের প্রটেস্টান্ট ধর্মের প্রবর্তক ও জার্মান দেশীয় ধর্মযাজক মার্টিন লুথারের মতন হ্যানিম্যানকে তৎকালীন গোঁড়া চিকিৎসকদের চিকিৎসা পদ্ধতির নানা প্রকার ভ্রম, কুসংস্কার ও মতবাদের বিরুদ্ধে একাকি দাঁড়াতে হয়েছিল। এজন্য তাকে অনেক লাঞ্ছনা, অনেক নিগ্রহ আর দুঃখ ভোগ করতে হয়েছিল। তথাপি তিনি অচল, অটলভাবে উচ্চকণ্ঠে ‘সদৃশ বিধান মন্ত্রের জয়’ ঘোষণা করে গিয়েছেন।

১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল বর্তমান জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের এল্ব নদীতীরবর্তী মিসেন নগরে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হ্যানিম্যান। তার বাবা ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রয়েড হ্যানিম্যান জার্মানির মিসেনে মাটির তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় চিনামাটির পাত্রে রঙ-তুলির কাজের দক্ষ শিল্পী ছিলেন।

শিশুকাল থেকেই হ্যানিম্যান অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। বিসয়টি টের পেয়ে পিতা ক্রিশ্চিয়ান পাঁচ বছর বয়স থেকেই প্রতিদিন হ্যানিম্যানকে নির্দিষ্ট সময়ে চিন্তা করার দীক্ষা দেন। সব নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার বিষয়ে হ্যানিম্যানকে শিশুকাল থেকেই গড়ে তোলেন তিনি।   `কোনও কিছু যুক্তিগ্রাহ্য না হলে শুধু বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করো না। অভিজ্ঞতার আলোকে যা সত্য বলে প্রমাণিত হবে, কোনো অবস্থাতেই তা থেকে সরে এসো না। ` পিতার এ উপদেশকে অনুসরণ করেই হ্যানিম্যান যে কোনো বিষয়কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ করার নীতি ও রীতি আয়ত্ব করেন।

তবে চরম দারিদ্র্য তার বিদ্যাচর্চার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। স্কুলজীবনে লেখাপড়ার জন্য রাতের বেলা প্রয়োজনীয় বাতির তেলের পয়সা জোগাড় করাও কষ্টকর ছিল তাদের পরিবারের পক্ষে। এ অবস্থায় হ্যানিম্যানের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তার বাবা। পরে স্কুলশিক্ষক রেক্টর এম মুলার অসাধারণ প্রতিভাবান হ্যানিম্যানকে বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন। তার প্রখর মেধার কারণে শিক্ষক মুলার তাকে স্কুলের অন্যান্য ছাত্রকে গ্রিক ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ভার দেন।

হ্যানিম্যান ১৭৬৭ সালের ২০ জুলাই মিসেনের টাউন স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে পাঠ চুকিয়ে বিদেশি ভাষা রপ্ত করতে ১৭৭৪ সালের ২০ নভেম্বর ভর্তি হন কাস্টেন এনডল্যান্ডের স্কুল সেন্ট আফ্রাতে। তিনি খুব অল্প সময়ে ১১টি ভাষায় (জার্মান, গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি, হিব্রু, ইতালিয়ান, সিরিয়াক, আরবি, স্প্যানিশ, ফরাসি ও চ্যালডেইক) সুপণ্ডিত হন।  

তবে চিকিৎসাবিদ্যা ছিল হ্যানিম্যানের প্রিয় বিষয়। ১৭৭৫ সালে তিনি লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার জন্য ভর্তি হন। এরপর সেখান থেকে ১৭৭৭ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার লিওপোল্ডস্ট্যাট জেলার ব্রাদার্স অব মার্সি হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে যান। সেখঅনে তিনি হিপোক্র্যাটিস, গ্যালন ও স্টোয়ার্কের লেখাগুলো সম্পর্কে বিশদ ধারণা পান। তিনি তার প্রখর ধীশক্তি, অসাধারণ অধ্যাবসায় ও চারিত্রিক সরলতার দ্বারা তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক ও চিকিৎসক ডা. কোয়ারিনের প্রিয়তম শিষ্য হয়ে ওঠেন। হ্যানিম্যান তার কাছে হাতে-কলমে রোগী দেখার শিক্ষা পান।
এ হাসপাতালে ৯ মাস থাকার পর হঠাৎ ছাত্রাবাস থেকে হ্যানিম্যানের সব টাকা-পয়সা চুরি হয়ে যায়। এতে তার লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। তখন ডা. জে ফন কোয়ারিনের সহযোগিতায় তিনি ট্রানসিলভেনিয়ার গভর্নর ব্যারন এস ফন ব্রুকেনহলের সঙ্গে হার্মানেস্ট্যাটে চলে যান। এখানে তিনি গভর্নরের মুদ্রা ও চিত্রকর্মের সংগ্রহশালার তত্ত্বাবধায়ক হয়ে লাইব্রেরিতে ব্যাপক পড়াশোনার সুযোগ পান। ১৭৭৯ সালে তিনি এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে তিনি হোফ্রাথ স্কোবারের কাছে এসে উদ্ভিদবিদ্যার পাঠ নেন। ১৭৭৯ সালের ১০ আগস্ট চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি `এমডি` উপাধি লাভ করেন। এই ডিগ্রি লাভের জন্য হ্যানিম্যান `আপেক্ষিক রোগের কারণ ও ইহার চিকিৎসা` বিষয়ে ২০ পৃষ্ঠার একটি ছাপানো গবেষণাপত্র পেশ করেছিলেন।

১০ বছর ধরে তিনি অত্যন্ত প্রতিপত্তির সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে তিনি লক্ষ্য করলেন, তৎকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি আন্দাজ, অনুমান, ব্যক্তিগত মতামত ও কিছু ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চিকিৎসার পরও রোগের পুনরাক্রমণ বারবার উপলব্ধি করেন তিনি। এভাবে তিনি ধীরে ধীরে অ্যালোপ্যাথির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
তিনি রসায়ন শাস্ত্র অনুশীলন এবং এসব বই অনুবাদ করে জীবিকা অর্জন করতেন। সে সময় চিকিৎসা পদ্ধতি দেখে হতাশ হয়ে বললেন_ সব চিকিৎসাপ্রথাই কাল্পনিক রোগ প্রতিকারের, প্রকৃত ওষুধ কোথায়? এমন দিনে হঠাৎ তার নিজের ঘরেই রোগের ভয়াল আক্রমণ শুরু হলে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় শিশুদের রোগযন্ত্রণা তাকে নতুন এক চিকিৎসার পদ্ধতি আবিষ্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে একদিন (১৭৯০ সালে) এডিনবার্গের বিখ্যাত অধ্যাপক, শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদ ডা. উইলিয়াম কালেনের লেখা চিকিৎসাবিষয়ক বই জার্মান ভাষায় অনুবাদকালে হোমিওপ্যাথির মূল সূত্র আবিষ্কার করেন।
হ্যানিম্যান গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন, যে পদার্থ সুস্থ শরীর যন্ত্রকে বিকৃত করে যেসব যন্ত্রণাদায়ক কৃত্রিম লক্ষণ সৃষ্টি করে, সে পদার্থের সূক্ষ্মমাত্রা বা শক্তিকে ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ করলে ওই লক্ষণাদি বিদূরিত করে শরীরযন্ত্রকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে পারে। এ পদ্ধতি অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির মতো জল্পনা-কল্পনা কিংবা অনুমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। টানা ছয় বছর এ পদ্ধতিতে তিনি নানা ওষুধ ও বহুবিধ তরল সেবন করে নিজ দেহের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। এ কাজে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন তার অনেক হিতৈষী।

এরপর তিনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির নীতিমালার বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন_ `মানুষের ওষুধ একমাত্র মানবদেহেই পরীক্ষিত হতে পারে; ইঁদুর, বিড়াল, গিনিপিগ, ঘোড়া, বানর কিংবা কোনো প্রাণীর ওপর নয়। ` তিনি তার এই বৈপ্লবিক চিকিৎসা পদ্ধতির নাম রাখলেন `হোমিওপ্যাথি`।

১৮১০ সালে প্রকাশ করেন অমর গ্রন্থ `অর্গানন অব মেডিসিন`। এ গ্রন্থের মাধ্যমে হ্যানিম্যান `হোমিওপ্যাথি` নামটি প্রকাশ করেন। অর্গাননের অর্থ হলো আরোগ্য সাধন। এ গ্রন্থে তিনি হোমিওপ্যাথির নীতিগুলোকে সূত্রবদ্ধ করেন। এতে রয়েছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কিত ২৯১টি সূত্র। এটি এমন গ্রন্থবিশেষ যার মাধ্যমে দার্শনিক তত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের নীতিমালার নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।
 
১৮১১ সালে হ্যানিম্যান বিখ্যাত গ্রন্থ `মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা` প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি সুস্থ মানবশরীরে পরীক্ষিত প্রতিটি ওষুধের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১৮১৭ সালে তিনি `রেপাটারিয়াম` নামক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে তিনি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ওষুধের বাছাই ও বিশেল্গষণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ১৮১১-১৮২০ সাল পর্যন্ত তিনি লিপজিগে প্রকাশ্যভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা চালিয়ে যান। বিভিন্ন ভাষায় বুৎপত্তির জন্য লিপজিগে তার সম্মান বর্ধিত হয়। কিন্তু পুনরায় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের ষড়যন্ত্র রাজরোষে পতিত হন। ১৮১৯ সালে সর্বসাধারণ্যে প্রচারের জন্য `মেডিকেল ইনস্টিটিউট` নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এরপর তিনি আনহ্যান্টিকিথেনে চলে যান। ১৮২১ সালে তিনি কিথেনের ইফারথ, অর্থাৎ কোটের কাউন্সিলর উপাধি পান। মূলত এ সময় থেকেই হোমিওপ্যাথিক জয়যাত্রা শুরু হয়।

বহু অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের হোমিওপ্যাথির ওপর ভক্তি বাড়তে থাকে। তখন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত চিকিৎসক কোয়েন হোমিওপ্যাথির অসারত্ব প্রমাণ করতে এসে হ্যানিম্যানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং স্বদেশ ফিরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। ১৮২৮ সালে হ্যানিম্যান `ক্রনিক ডিজিজেস` নামক গ্রন্থটি চার খণ্ডে প্রকাশ করেন। এতে তিনি চিররোগের কারণ, তাদের স্বরূপ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৮২৯ সালে কেবল সংবাদপত্রে কলেরা রোগের লক্ষণগুলো পাঠ করে হোমিওপ্যাথিক মতে এর চিকিৎসা প্রচার করে সেই মতে বহুরোগী আরোগ্য লাভ করে। এতে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা আরও একবার প্রমাণ করেন হ্যানিম্যান।

১৮২৯ সালের ১৩ আগস্ট তার এমডি উপাধিপ্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে প্রদত্ত ভোজসভায় গঠিত হয় জার্মান সেন্ট্রাল হোমিওপ্যাথিক ইউনিয়ন। ১৮৩১ সালে তিনি হোমিও মতে `কলেরা রোগের চিকিৎসা` নামক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৩৩ সালে তিনি লিপজিগে একটি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল স্থাপন করেন। একই বছরে অর্গাননের পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশ করেন। ১৮৩৪ সালে আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক হেরিং হোমিওপ্যাথির অসারত্ব প্রমাণ করতে এসে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্বদেশ গিয়ে হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

ভাষাবিদ, অনুবাদক ও লেখক হিসেবে হ্যানিম্যানের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। তার জানা ১১টি ভাষায় লেখা হিপোক্রেটিস থেকে শুরু করে পরবর্তী আড়াই হাজার বছরের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস পড়েন ও এর বিশ্লেষণ করেন। তিনি বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা, দর্শন ও সাধারণ সাহিত্যকর্ম বিষয়ে বিভিন্ন ভাষা থেকে জার্মান ভাষায় অসংখ্য বইপত্র অনুবাদ করেন। প্রতিটি অনুবাদেই তিনি প্রয়োজনীয় মন্তব্য ও ব্যাখ্যা দিতেন। তা অনেক সময় মূল লেখা থেকেও বেশি আকর্ষণীয় হতো।

তিনি প্রায় ১১৬টি বৃহৎ গ্রন্থ ও অসংখ্য ছোট প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে শুধু ২৩টি রসায়ন শাস্ত্রের। রসায়ন বিদ্যা ও ওষুধ প্রস্তুতকারক হিসেবেও তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তিনি এ বিষয়ে অনেক মৌলিক প্রবন্ধ ও বই রচনা করেন। হ্যানিম্যানের এসব অবদানের জন্য প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফেসর বার্জেনিয়ার্স তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। হ্যানিম্যান পরীক্ষার লক্ষে নিজের দেহে ৯৯টি (গার্থবোরিক ও ডা. রিচার্ড হেলের মতে ১০০টি, ডা. জেমস ক্রস ও ডা. আর ই ডাজেনের মতে ৯০টি) ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু এ নতুন ওষুধ প্রস্তুত ও প্রচলন এবং একজন চিকিৎসক হয়ে নিজের ওষুধ নিজে প্রস্তুত করায় লিপজিগ অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতারা হ্যানিম্যানের চরম বিরোধিতা করেন। এমনকি তাকে লিপজিগ থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করেন।
 
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন হ্যানিম্যান। অ্যালোপ্যাথিক গ্রন্থকার ডা. হিউজেস বেনোউ, লন্ডনের রয়াল মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. ইভান্স, ফিলাডেলফিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. বেঞ্জামিনরাশসহ অনেক বিশ্ববিখ্যাত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের উক্তিতে দেখা যায়, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরোগ্যের কোনো মৌলিক নীতি নেই। অন্যদিকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সার্জন এবং বায়োলজির গবেষক ডা. আগস্ট বায়ার হোমিওপ্যাথি অধ্যয়ন ও চর্চা করার পর লিখেছেন, `হ্যানিম্যান আমাদের চেয়ে এক শতাব্দী এগিয়ে আছেন। `

ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক স্যার জন ওয়্যার বলেন, `হোমিওপ্যাথিকে যাচাই করতে এসে হোমিওপ্যাথ হয়ে গেছি। ` প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মরগ্যান বলেন, `আরোগ্যের বিশ্বজনীন নিয়ম আবিষ্কার এবং ভেষজ বস্তুকে শক্তিকৃত করে ব্যবহার করার নিয়ম প্রবর্তনের অক্ষয় সম্মান ও খ্যাতি হ্যানিম্যানের প্রাপ্য। `

হ্যানিম্যান মৃত্যুর আগপর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কথিত আছে, তার চেম্বারে এত রোগী হতো যে, রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম পড়ে যেত। প্যারিসে আট বছর অবস্থানকালে তিনি চিকিৎসা সূত্রে চার লাখ ফ্রাঙ্ক আয় করেন। ১৮৪৩ সালের ২ জুলাই ভোর ৫টায় প্যারিসে নিজ ঘরে আর্তজনের হ্যানিম্যান জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১১ জুলাই প্যারিসের মন্ট হ্যাচারি গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

‘ইহজগতে আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই’
হ্যানিম্যান পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন হোমিওপ্যাথির পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের সাধনায়। চিকিৎসা জগতে দুর্যোগের ঘনঘটা তাকে আশঙ্কামুক্ত করতে পারেনি। তাই তিনি গবেষণার পাশাপাশি চিকিৎসক সমাজের দায়িত্বহীনতা, চিকিৎসার নামে অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।
হ্যানিম্যান ছিলেন নীতিতে অটল এক মানুষ। শত বাধাও তাকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি সব চিকিৎসককে আদর্শ-নিয়মে বৈজ্ঞানিক ও নির্ভরযোগ্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির অনুসারী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তিনি টনিক, মলম, ইনজেকশন এবং ওষুধের মূল আরক ও স্থূলমাত্রার ওষুধ প্রয়োগের চরম বিরোধিতা করেন। যারা এ ধরনের নীতিহীন চিকিৎসা করেন, তিনি তাদের উভয় লিঙ্গ, জারজ ইত্যাদি বলে মন্তব্য করেন। হ্যানিম্যানের আত্মোৎসর্গের সুফল তার জীবনকালেই পৃথিবীতে বৈপ্লবিক সাড়া জাগায়। তাই তো বিদায় বেলায় তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘ইহজগতে আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই। ’

ডা. হ্যানিম্যান দু`বার বিয়ে করেন। জার্মানির গোয়েরনে থাকার সময় তিনি প্রায় ২৮ বছর বয়সে ১৯ বছরের জোহনা হেনরিয়েটি লিও পোলডিনি কুসলারকে ১৭৮২ সালের ১৭ নভেম্বর বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন হ্যানিম্যানের দুঃখ, দারিদ্র্য, নিপীড়িত ও যাযাবর জীবনের সুযোগ্য সহধর্মিণী। তার গর্ভে হ্যানিম্যানের দু`ছেলে ও নয় মেয়ের জন্ম হয়। তারা হলেন হেনরিয়েটি, ফ্রেডিক, ভিলহেলমিনি, এমিলি, ক্যারোলিনি, আনস্ট, ফ্রেডিকি, ইলিওনোরি, চার্লোটি ও লুইসি। ১৮৩০ সালের ১৩ মার্চ জোহনার মৃত্যু হয়।

১৮৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি জার্মানির কোথেনে অবস্থানের সময় হ্যানিম্যান প্রায় ৮০ বছর বয়সে মাদার মেরি মেলানি ডি হারভিলি নামে ৩২ বছর বয়সী এক ফরাসি মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী, বিশিষ্ট চিত্রকর ও নামকরা কবি ছিলেন। হ্যানিম্যানের চরম সাফল্যের দিনগুলোতে তিনি সুযোগ্য সহধর্মিণী হিসেবে যথেষ্ট অবদান রাখেন। শেষ জীবনে তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। হ্যানিম্যানের চিকিৎসার কাজেও তিনি সহযোগিতা করতেন। মাদার মেলানি নিঃসন্তান ছিলেন; কিন্তু হ্যানিম্যানের মৃত্যুর কিছুদিন আগে হ্যানিম্যানের বিশেষ অনুরোধে সোফি বোরার নামে পাঁচ বছরের এক মেয়েকে মেলানি তার পালিতা মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন।

অপরদিকে, দ্বিতীয় বিয়ের প্রায় চার মাস পর হ্যানিম্যান তার সব সম্পত্তি কন্যা ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীর নামে উইল করে দিয়ে যান।

হ্যানিম্যান মাত্র ২৪ বছর বয়সে এমডি ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হিসেবে জার্মানির ম্যানস্ফিল্ড প্রদেশের হেটস্টেড শহরে প্রথম চিকিৎসা শুরু করেন। এখান থেকে তিনি দেশাই শহরে যান এবং রসায়ন শাস্ত্রে বিশেষ মনোনিবেশ করেন। পরে তিনি শ্রেষ্ঠ রসায়নবিদরূপে খ্যাতি লাভ করেন। চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগের পর প্রচলিত পদ্ধতির ওপর তার সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে। তিনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি পরিত্যাগ করে সাহিত্য ও রসায়ন শাস্ত্র আলোচনা করার মনস্থ করেন।

১৭৮৫ সালে হ্যানিম্যান ড্রেসডেনে আসেন। এখানে তিনি প্রায় এক বছর শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেন ও চিকিৎসাবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করেন। ড্রেসডেনে থাকার সময় অ্যালোপ্যাথির প্রতি তার আরও বিরাগ জন্মে। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ও মতামত বিভিন্ন প্রবন্ধে প্রকাশ করেন।

১৭৮৯ সালের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তিনি লিপজিগে চিকিৎসা শুরু করেন। এ সময় তার `যৌন রোগে সার্জনদের প্রতি নির্দেশনা` গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। একই বছর `স্বাস্থ্যের বন্ধু` বইতে স্বাস্থ্যবিধি ও জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন এবং `সিফিলিস প্রসঙ্গে` প্রবন্ধে সিফিলিসে পারদের সূক্ষ্মমাত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।

সূত্র: অধ্যাপক ডা. দেবব্রত ভট্টাচার্য

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, ১০ এপ্রিল, ২০১২

শব্দ: ১৮৭১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।