ঢাকা: কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরসহ সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, টিকাদান কর্মসূচি ও কোভিড-১৯ টিকাদানে ব্যাপক সফলতা অর্জন এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।
দেশের সব মানুষের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে গুণগতমানের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই হলো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মূলনীতি।
বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য খরচের প্রায় ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এ ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫১, যেখানে নেপালের ৫৩, ভারতের ৬১, ভুটানের ৬২, শ্রীলঙ্কার ৬৭ ও মালদ্বীপের ৬৯। অন্যদিকে ৪৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের নিচে আছে পাকিস্তান, আর আফগানিস্তানের স্কোর ৩৭।
প্রতি বছর ৭ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে `হেলথ ফর অল'। অর্থাৎ সবার জন্য স্বাস্থ্য।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে গুণগত মানের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার ধারণা থেকে এখনো অনেক দূরে রয়েছে। এভাবে চললে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব কি-না সেই বিষয়েও দ্বিমত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে প্রতি বছর নতুন করে ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যতার শিকার হচ্ছেন। এজন্য ওষুধ আর পরীক্ষা নিরীক্ষার উচ্চমূল্যকে দায়ী করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা তহবিল গঠনের পরামর্শ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
এই বিষয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ, যেটা সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবার (হেলথ ফর অল) মূল মন্ত্র। ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের প্রধান কথা হচ্ছে সবার জন্য মানসম্মত মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে অর্থের জন্য কেউ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে না। এটি রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।
তিনি আরও বলেন, ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ যতক্ষণ অর্জন হচ্ছে না, ততক্ষণ সেকেন্ডারি, টারশিয়ারিতে উচ্চ অবকাঠামোগত স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন যতই দেখাই না কেন, এতে খুব বেশি লাভ হবে না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ জনগণ তার আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে আধুনিক এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে কি-না বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, আমরা ২০৩০ সালে মধ্যে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জন করবো। প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের যে সূচক সেগুলোর মধ্যে মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু এগুলোতে আমাদের যা অর্জন তা ২০১৫ সালের আগেই অর্জন করেছি, যা বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করেছে। কিন্তু একটা বিষয় তখনো উদ্বেগজনক ছিল, ২০১১ সালে সরকারের ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের গবেষণায় দেখা যায় ১০০ টাকা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হলে তার মধ্যে ৬৩ টাকাই ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এটা অনেক বেশি, সারা বিশ্বে ব্যক্তির পকেট থেকে গড়ে ৩২ শতাংশ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির পকেট থেকে ৬৩ শতাংশ ব্যয়, এটা ওই সময়েই আতঙ্কজনক ছিল। সে জন্য ২০১২ সালে একটা হেলথ ফাইন্যানসিং স্ট্রাটেজি করা হয়েছিল, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যক্তির ব্যয় ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ অর্থের জন্যে দরিদ্র বা অনগ্রসর কেউ যেন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।
বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির ব্যয় প্রসঙ্গ উল্লেক করে তিনি বলেন, দুঃখের বিষয় কমার পরিবর্তে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির খরচ আরও বেড়ে গেছে। ২০১৬ সালের মূল্যায়নে দেখা গেল খরচ আরও বেড়ে ৬৭ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি আরও ন্যাশনাল হেলথ একাউন্সের একটি গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে এই খরচ পরিমাণ হয়েছে ৬৭.৫ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যনুযায়ী এটা আরও বেশি হবে। আমাদের তথ্যের কথাই যদি বলি, তাহলে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবায় উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। সূচকগুলোর দিকে যদি আমরা দেখি সেখানেও ২০১৫ সালের পর থেকে এক ধরনের স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। সূচকগুলো যদি উন্নতির দিকে থাকতো তাহলে বুঝতাম যে সঠিক পথেই আছি।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সঠিক পথে না এগোনোর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। যেমন ২০০৬-০৭ সালের সাথে আমরা যদি তুলনা করি, সেখানে সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অংশগ্রহণ ছিল ৩৫ বা ৩৮ শতাংশ। এখন সেটা কমে এখন ২৩ শতাংশে নেমে গেছে। আমরা যদি স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের শতাংশ ধরি সেখানেও বাড়েনি, জিডিপির শতাংশও তেমন বাড়েনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য বলেন, আরেকাটা উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে যেটুকু খরচ হচ্ছে সেখানেও অনেক অনিয়ম রয়েছে। সেকেন্ডারি এবং টারশিয়ারিতে স্বাস্থ্য খাতের অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আর মাত্র সাত বছর বাকি আছে, আমরা কি সঠিক পথে যাচ্ছি, তথ্য বলছে না আমরা কোথায় যেন আটকে আছি, কিছু ক্ষেত্রে উল্টো পথে হাঁটছি। এটা যদি এখনি অনুধাবন করা না হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য যে স্বপ্ন তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৩
আরকেআর/এসআইএস