ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বাংলানিউজকে মন্ত্রী নাসিম

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ব্যবসা করতে দেবো না

মহিউদ্দিন মাহমুদ ও মাজেদুল নয়ন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ব্যবসা করতে দেবো না

ঢাকা: স্বাস্থ্যখাতে সব ধরনের অনিয়ম বন্ধে স্বাস্থ্যনীতিকে কঠোর আইনে রূপান্তরিত করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

ডাক্তার, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ শিল্পসহ স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নামের সঙ্গে জড়িত সেবা।

নাম হলো স্বাস্থ্যসেবা। এখানে বাণিজ্য হলে সেবা থাকবে না। সরকার তো আর জনগণের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারে না। তাই আইনে কোনো ফাঁকফোকর থাকবে না।

তিনি বলেন, গার্মেন্টস মালিক, মাছ রপ্তানিকারক কিংবা অন্য ব্যবসায়ীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নিচ্ছে, তারা মেডিকেল কলেজেরও মালিক হতে চান। কিন্তু কেন? কিছু কিছু লোক আছে যারা সব জায়গাতে ব্যবসা করতে চায়।
 
সম্প্রতি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে, এ খাত-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে  বাংলানিউজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এসবের মধ্যে আছে স্বাস্থ্যখাতের নানা অনিয়ম, স্বাস্থ্য নীতিমালাকে আইনে রূপান্তর করা, দরিদ্র মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা, ডাক্তারদের কর্মস্থলে থাকা, ডাক্তারদের গ্রামে রাখতে প্রণোদনা, ওষুধে ভেজাল রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ আরো নানা বিষয়। একান্ত সাক্ষাৎকারটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

অনিয়মগুলো চোখে পড়ছে

দায়িত্বগ্রহণের শুরুতে নেওয়া পদক্ষেপ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, কিছু ডাক্তার নাকি আমার ওপর ক্ষেপে যাচ্ছেন? আমার এক সহকারীকে তারা জিজ্ঞেস করেছে, স্যার (মন্ত্রী) ডাক্তারদের ওপর এত বিরক্ত কেন?
 
এ প্রসঙ্গে সরকারের এই প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেন, ডাক্তারদের অনিয়মগুলো চোখে পড়ছে। বোয়ালখালীতে একজন ডাক্তার (ডা. তাহমিনা দেওয়ান) ১২ দিনের অগ্রিম হাজিরা দিয়েছেন। অগ্রিম টাকা নেওয়া, অগ্রিম লোন নেওয়ার ঘটনা শুনেছি। কিন্তু অগ্রিম হাজিরা দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম দেখলাম। তার ‍বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ডাক্তারদের নানান অনিয়মের কথা সবাই জানে। অনেকে প্রেসক্রিপশন লিখে পছন্দের ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে কমিশন খায়। অথচ মরহুম জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সাহেব যে ওষুধ দিতেন সেটা দুই টাকায় কেনা যেত। মানুষ সেটাই খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠতো।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অনেক ডাক্তার আছেন যারা এক বসাতে ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার রোগী দেখেন। উন্নত বিশ্বে ডাক্তাররা সময় নিয়ে রোগী দেখেন। সেখানে ডাক্তারদের সঙ্গেই কথা বললে রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। আমাদের এখানে রোগী ডাক্তারের কাছে গেলেই জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? ও এই সমস্যা। (কিছু একটা লিখে) ঠিক আছে... যান। এটা কোনো কথা হলো?

চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরি হচ্ছে। এখানে রক্ত পরীক্ষা, ওমুক-তমুক পরীক্ষা করা হয়। এমনও দেখা গেছে, রোগীর কিছুই হয়নি তবুও তাকে বলা হলো ক্যান্সার হয়েছে। এ ধরনের মানহীন প্রতিষ্ঠান একের পর এক গড়ে উঠছে।

নাসিম বলেন, এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মাধ্যমে ডাক্তারা টেস্ট বাণিজ্য করছে। এগুলো বন্ধ করা হবে। কিন্তু সব এক সঙ্গে বন্ধ করা সম্ভব না। গ্রাম পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয়ের কাজ রয়েছে। ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করে এসব অনিয়ম বন্ধ করা হবে।

অনিয়ম বন্ধে কঠোর আইন হবে

অনিয়ম বন্ধে স্বাস্থ্য নীতিমালাকে আইনে রূপান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ নাসিম। চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে এ নিয়ে আলোচনা হবে।

তিনি বলেন, একটা স্বাস্থ্য নীতিমালা আছে। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে নীতিমালার ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রসঙ্গ টেনে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ১৪ মেডিকেল কলেজ বন্ধ করেছি। সেখানে দেখা গেছে, চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নাই, কারো জমি নাই, কোথাও হয়তো শিক্ষক নাই। মেডিকেল কলেজ থেকে তো ডাক্তার বেরুবে। মেডিকেল কলেজে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক, হাসপাতাল এবং নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নীতিমালাকে সংসদের পাসের মাধ্যমে আইনে রূপান্তর করতে যাচ্ছি। আইনের শর্ত পূরণ না করলে কাউকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হবে না।

‘কিছু লোক সব জায়গাতে ব্যবসা করতে চায়’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, যারা মেডিকেল কলেজ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন তারা তো নিজের গ্রামে একটা মানসম্মত হাসপাতাল বা একটা স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ করতে পারেন। সেটা না করে তারা মালিক হয়ে ব্যবসা করতে চাইবেন কেন?

দরিদ্রদের হেলথ কার্ড দেওয়া হবে

স্বাস্থ্যবীমা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পের কথা ভাবছি। বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য।

স্বাস্থ্যবীমার জন্য দরিদ্রদের একটা হেলথ কার্ড দিয়ে দেওয়া হবে। যা দিয়ে তারা যেকোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবে। পরে সরকার টাকা পরিশোধ করে দেবে। এ কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্ররা অর্ধেক বা বিনে পয়সায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবে।

ভেজাল ওষুধ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা

মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দেশে জিঞ্জিরা মার্কা অনেক ওষুধ কারখানা গড়ে উঠেছে। ভেজাল ওষুধ খেয়ে কেউ সুস্থ হতে এসে মারা যাবে। এটা হতে দেওয়া যায় না।

‘ভেজাল ওষুধ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ এ প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ওষুধ মালিক সমিতি ও ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে বসেছি। তারাও এটি বন্ধে আগ্রহী। সবার সঙ্গে আলোচনা করে কঠোর পদক্ষেপ নেবো।

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে

মন্ত্রী নাসিম বলেন, সম্পদের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন করতে হবে। দিন দিন স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ছে অথচ বরাদ্দ কমছে। আগামী বাজেটের আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর
উদ্যোগ নেবো। বরাদ্দ না বাড়ালে তো কাজ করতে পারবো না।

স্বাস্থ্যখাতে জনবলের ঘাটতির বিষয়ে তিনি বলেন, লোক নিয়োগের বিষয়ে জনপ্রশাসনে প্রস্তাব আছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এখানে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। দীর্ঘসূত্রিতা নিরসনে আন্ত:মন্ত্রণালয় মিটিং করবো।

মন্ত্রী বলেন, জাতীয় কাউন্সিল মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জনবল নিয়োগ, স্বাস্থ্যবীমা, অর্থ বরাদ্দ, গ্রামে যাওয়া ডাক্তারদের প্রণোদনা, যাকে-তাকে ইউনিভার্সিটি অনুমোদন দেওয়ার বিষয়- এসব তুলে ধরে দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করবো।

ডাক্তাররা গ্রামে থাকলে বিশেষ প্রণোদনা

ডাক্তারদের গ্রামে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে শাস্তির পাশাপাশি প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

নাসিম বলেন, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িসহ আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের সেবায় যেসব ডাক্তাররা যাবে তাদের আমরা প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবছি। এছাড়া যারা গ্রামে কমপক্ষে দুই বছর থাকবে তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিসহ পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

বিশেষায়িত সেবা সম্পর্কে  জনগণকে অবহিতকরণ

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার অনেক সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকে এটা জানে না।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে নিউরো সার্জারির এত উন্নত চিকিৎসা আছে এটা আমি নিজেও জানতাম না। এখানে ব্রেন টিউমার অপারেশন হচ্ছে। বিশ্বমানের এ হাসপাতালে ৬ হাজার টাকার টেস্ট মাত্র ২ হাজার টাকায় করানো হয়। এখানে যে যন্ত্রপাতি রয়েছে তা দামি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও নেই। এ হাসপাতালে গরীবদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

টেলিমেডিসিন, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কিডনি, হার্টের চিকিৎসাসহ সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব বিশেষায়িত চিকিৎসা রয়েছে, সে ব্যাপারে জনগণকে জানাতে বিশেষ উদ্যোগ নেবেন বলে জানান মন্ত্রী।

অতীত থেকে শিক্ষা নেব

মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দায়িত্বে এসে মাথায় লোড নিয়ে নিয়েছি। মানুষের মনে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে সামনে এগুবো। কিছু করতে না পারলে তোমরাই তো লিখবা, ‘খালি ফাঁকা আওয়াজ দেয়’।

মন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপের কথা আমি ভেবে রেখেছি। এগুলোতে রাতারাতি সম্ভব নয়। চিন্তা ভাবনা করে ধাপে ধাপে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে ভুল তো মানুষই করে।

গত কয়েক দিনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বপালনের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কাজকে খুব উপভোগ করছি। আমি রাজনীতি করেছি। এখানে মানুষের সেবা করার একটা সুযোগ পেয়েছি। এটা ভালো লাগছে। নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবো। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভুল ত্রুটি হতে পারে। তবে আমি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দায়িত্ব পালন করবো।

বাংলাদেশ সময়: ০০১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৪/আপডেটেড: ১০৪০ ঘণ্টা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।