ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

নামমাত্র খরচে নাক-কান-গলার চিকিৎসা

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৫
নামমাত্র খরচে নাক-কান-গলার চিকিৎসা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: নামমাত্র খরচে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় নাক-কান-গলা (ইএনটি) ইনস্টিটিউটে মিলছে নাক, কান ও গলার সব ধরনের চিকিৎসা। এমনকি রক্তনালীর টিউমার, প্যারেটিড গ্রন্থির টিউমার, থাইরয়েড বা গলগন্ড এবং জিহ্বার টিউমারের মতো জটিল অপারেশনও করা হচ্ছে বিনা খরচে।


 
জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট দেশের একমাত্র সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান যেখানে বর্হিবিভাগে রোগী দেখেন বিশেষজ্ঞ (কনসালট্যান্ট) চিকিৎসকরা। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বর্হিবিভাগে চলে এক টানা রোগী দেখা।
 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ উদ্যোগে ২০১৩ সালের ১৯ জুন থেকে সেবা দেওয়া শুরু হয় নাক, কান ও গলার বিশেষায়িত এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটিতে। প্রথমদিকে সীমিতভাবে শুধু বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা ইন্সটিটিউটে চলতি বছরের নভেম্বর থেকে বর্হিবিভাগের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা দেওয়া হচ্ছে জরুরি চিকিৎসা সেবা।

বর্হিবিভাগে একজন রোগী মাত্র ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে নাক, কান অথবা গলার যে কোন রোগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাবেন। প্রয়োজন হলে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে থাকা অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকরাও রোগী দেখেন।
 
বিভাগীয় প্রধানরা ইএনটি ওয়ার্ক স্টেশনের (ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরে যে ধরনের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয় সেই ধরনের যন্ত্রপাতি) মাধ্যমে রোগ নিশ্চিত করে চিকিৎসা দেন অথবা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
 
যদি কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন তাহলেও চিকিৎসা সেবা পেতে খুব বেশি অর্থ খরচ করতে হয় না। এ জন্য ভর্তি হতে লাগে মাত্র ১৫ টাকা। এরপর যে কোন পরীক্ষা থেকে শুরু করে অপারেশন করা হয় বিনামূল্যে। এমনকি রোগীকে ওষুধ (সরকার থেকে যে সব ওষুধ সরবরাহ করা হয়) ও তিন বেলা খাবারও সরবরাহ করা হয়।

এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির ১শ’ বেডের মধ্যে ৬০টি বেডই ফ্রি সেবার আওতায় রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা, দুস্থ, গরিব ও প্রতিবন্ধীরা এই ফ্রি সেবা পেয়ে থাকেন।

এছাড়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিআইপি) জন্য আছে ২টি কেবিন। এ ২টি কেবিনের চিকিৎসা সেবাও সম্পূর্ণ ফ্রি।
 
বাকি ৩৮টি বেডের রোগীদের অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়। এরমধ্যে ২৬টি পেয়িং বেড। এই বেডের জন্য রোগীদের প্রতিদিন ২৭৫ টাকা দিতে হয়। আর অপারেশনের ক্ষেত্রে বড় অপারেশনের জন্য ১ হাজার টাকা এবং ছোট অপারেশনের জন্য ৫’শ টাকা দিতে হয়।
 
এছাড়া আছে ১০টি নন-এসি ও ২টি এসি কেবিন। নন-এসি কেবিনের ভর্তি চার্জ ৪’শ টাকা এবং এসি কেবিনে ১ হাজার টাকা। এই দুই কেবিনের রোগীদের অপারেশনের ক্ষেত্রে বড় অপারেশনে ২ হাজার টাকা এবং ছোট অপারেশনে ১ হাজার টাকা দিতে হয়।

জাতীয় নাক-কান-গলা (ইএনটি) ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ইএনটির বহির্বিভাগ থেকে ৩১ হাজার ৪৩৫ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ ১৮ হাজার ৭৯৮ জন এবং মহিলা ১২ হাজার ৬৩৭ জন। আর ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৬৪৪ জন। এরমধ্যে ১ হাজার ১২২ জনই ফ্রি চিকিৎসা নিয়েছেন। যার মধ্যে ৫৮৬ জন পুরুষ ও ৫৩৬ জন মহিলা।
 
সূত্রটি জানিয়েছে, চলতি বছরে ইএনটিতে ১ হাজার ৪৫৯ জন রোগীর অপারেশন করা হয়েছে। এরমধ্যে কানের অপারেশন করা হয়ছে ৩৫৮টি, নাকের ৩৯০টি, গলার ৭০৭টি ও চোখের ৪টি। ‍এর মধ্যে রক্তনালীর টিউমার, প্যারেটিড গ্রন্থির টিউমার, থাইরয়েড বা গলগণ্ড এবং জিহ্বার টিউমারের মতো জটিল অপারেশনও করা হয়েছে।
 
ইএনটির সহযোগী অধ্যাপক জাকারিয়া সরকার জানিয়েছেন, জিহ্বার টিউমারে আক্রান্ত ৬০ বছরের আবদুর রবকে অপারেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনা খরচে নতুন জিহ্বা স্থাপন করা হয়েছে এবং ১৪ বছরের জয়নাবের রক্তনালীর টিউমার অপারেশন করা হয়েছে। দুজনই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
 
যোগাযোগ করা হলে ইএনটির পরিচালক মাহমুদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, সরাসরি চিকিৎসা সেবা দেওয়া, নাক-কান-গলার ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের দক্ষ করে তোলা এবং নাক-কান-গলা রোগ সম্পর্কে সচেতনা বৃদ্ধি করা এই হাসপাতাল নির্মাণের প্রধান কারণ।
 
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতলটি প্রধানমন্ত্রী নিজেই সরাসরি তদারকি করছেন। এখানে নাক-কান-গলার সব ধরনের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। বহির্বিভাগে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগী দেখেন।
 
মাহমুদুল হাসান আরও বলেন, এখানে চিকিৎসা নিতে রোগীর ৩৫ শতাংশই কানের রোগী। মূলত অসচেতনতার কারণেই মানুষ কানের রোগে ভোগেন। অভ্যাসগত কারণেই আমাদের কান চুলকায়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কান খোঁচানো উচিত নয়। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকা উচিত।
 
আর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে আমরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেবা সপ্তাহ পালন করেছি। এতে আমরা বেশ সাড়া পেয়েছি। এখন প্রতিদিন বহির্বিভাগে ২’শ থেকে আড়াই’শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। আমরা চাই ইএনটিতে সেবা নিতে আরও বেশি বেশি রোগী আসুক।
 
সরকারি কোষাগারে ৪৪ লাখ টাকা জমা:
সাধারণ রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি ইএনটি থেকে চলতি বছরের ১০ মাসে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৪ লাখ ৯ হাজার ৯৮৫ টাকা। এরমধ্যে টিকিট বিক্রি থেকে এসেছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ১৯০ টাকা। কেবিন থেকে এসেছে ১৯ লাখ ৩০ হাজার ৫৫০ টাকা। এছাড়া পেয়িং বেডে ভর্তি বাবদ ২৯ হাজার ৩৫৫ টাকা, অপারেশন থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার, অডিওলজি পরীক্ষা থেকে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা, প্যাথলজি পরীক্ষা থেকে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০ টাকা, এফ ও এল বাবদ ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা এবং সিডিউল বিক্রয় থেকে ৫১ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
 
খালি চিকিৎসক পদ ও বন্ধ আইসিইউ সেবা:
২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া ১শ’ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসক পদ রয়েছে ৯৪টি। এরমধ্যে ৫৯ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখনো ৩৫টি পদ খালি পড়ে আছে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির ৪৪টি পদের মধ্যে ১৯টি, চতুর্থ শ্রেণির ২টির মধ্যে ২টিই এবং নার্সসহ দ্বিতীয় শ্রেণির ৬৩টি পদের মধ্যে ১টি পদ খালি আছে।
 
অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো এ হাসপাতালটিতে আইসিইউ স্থাপন করা হলেও তা থেকে রোগীরা কোনো সেবা পাচ্ছেন না। দক্ষ জনবলের অভাবে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকার পরও রোগীদের আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে ইএনটির একাধিক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইএনটির পরিচালক বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আশা করি শিগগিরই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
 
ইএনটির অবস্থান ও সেবা:
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের লাভ রোডে নাক-কান-গলার এই বিশেষায়িত হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়েছে। হাসপাতালটিতে আছে ক্যাজুয়ালিটি অপারেশ থিয়েটার (ওটি) সহ ৭টি ওটি। অত্যাধুনিক অডিও ভেস্টিবুলার ল্যাব, স্লিপ স্টাডি ল্যাব, স্কিল ল্যাব, ইএনটি ওয়ার্ক স্টেশনসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও চালু আছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
এএসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।