পটুয়াখালী থেকে ফিরে: কোনো হাতুড়ে ডাক্তারের কাণ্ড নয়, যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ক্লিনিকের ঘটনাও এটি নয়। টর্চের আলোয় অস্ত্রোপচারের ঘটনা ঘটছে পটুয়াখালীর ২৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালে।
২০১৫ সালে প্রায় দুই লাখ রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে যে হাসপাতাল, সেটিরই অপারেশন থিয়েটারের চিত্রে চরম রুগ্নতা। পর্যাপ্ত বাতি নেই, ওটি উপযোগী জেনারেটর নেই। তাই ছোট-বড় অপারেশনে টর্চই ভরসা।
সম্প্রতি হাসপাতালটির কর্তব্যরতদের সঙ্গে আলাপচারিতায় পাওয়া গেলো এসব তথ্য।
চিকিৎসরকরা বলছেন, ওটিতে যা যা প্রয়োজন, সেসব নেই। তিনটি আবশ্যক লাইট নেই, জেনারেটর নেই। দু’টি ওটি- গাইনি ও সার্জারি বিভাগে। এগুলোর জন্য একটিমাত্র চার্জার লাইট ছিলো, সেটিও ছয় মাস ধরে নষ্ট। বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রায়ই তাই টর্চের আলোতে অপারেশন করতে হচ্ছে।
তারা বলেন, টু-ফেস জেনারেটর প্রয়োজন এমন অপারেশন থিয়েটারে। একটি লাইন ছিলো, সেটি এখন নষ্ট। একটিমাত্র স্পট লাইট, ৩২ ওয়াটের বাল্বে জরুরি কাজ চলছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে টর্চের আলোতে রিস্ক নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
বড় অঘটন ঘটে গেলে দায়টা তাদের ঘাড়ে আসার আতঙ্কের কথাও জানালেন।
তাই বলে টর্চের আলোয় অপারেশন? জবাবে তারা বলছেন, এমন করতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীদের চাপেই।
কর্তব্যরত ডা. জাকিয়া সুলতানা কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, এমন অপারেশন আমরা কেন করতে চাইবো? রোগীরা বাধ্য করছেন করতে। ভরসা করে এখানে নিয়ে আসেন জটিল রোগী। ‘লাইট নেই’, বলার পরও রেফারে রাজি হন না অনেকে। বলেন, বরিশাল যেতে যেতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু এমন অপারেশনে দুর্ঘটনার দায়তো শেষমেষ আমাদেরই ঘাড়ে আসবে।
হাসপাতালের নথি ঘেঁটে দেখা গেলো, প্রতিদিন গড়ে ৪শ রোগীকে আউটডোরে সেবা দেওয়া হয় এখানে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে ইনডোরে ২৮ হাজার ৩শ ৪৮ রোগী সেবা নিয়েছেন। বহির্বিভাগ থেকে এ বছর মোট এক লাখ ৫৬ হাজার রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে।
সর্বমোট এক লাখ ৯৫ হাজার ৩শ রোগী সেবা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৬৯ হাজার ৫শ ৫৩ জন নারী ও ৪৫ হাজার ২শ ৯৫ জন শিশু। জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৩৯ হাজার ৭৬ জন।
সারাবছর আগতদের বেশিরভাগ সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া নিয়ে এসেছেন। আর বেশকয়েকজন রোগী এসেছেন গুরুতর সমস্যা নিয়ে। নারী রোগীদের মধ্যে প্রসবরোগী বেশি আসেন। এছাড়া পেপটিক আলসারের রোগীও নারীরাই বেশি।
আগত ৯০২ জন প্রসূতির মধ্যে সিজারসহ বেশ কয়েকজনের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। ইনডোরে মৃত্যুহার কম।
মোট প্রসব এক হাজার ৬শ ৩৬ জন, জীবিত জন্ম এক হাজার ৫শ ৩৬, মৃত শিশু ৮৪ ও মাতৃমৃত্যু আটজন। তাদের মধ্যে প্রি-এক্লাম্পশিয়ার (খিঁচুনি) রোগী বেশি বলে জানান ডা. জাকিয়া সুলতানা।
এছাড়া প্রসবপূর্ব ও পরবর্তী রক্তক্ষরণজনিত কারণ, উল্টোবাচ্চা, বাড়িতে প্রসবের চেষ্টাকালে পানি ঝরে যাওয়ার কারণে বেশি জটিলতা হয়। তখন হাসপাতালে নিয়ে এসেও বিপদ এড়ানো যায় না বলে বলে জানান তিনি।
এমনিতে সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পুরো বিভাগে বরিশাল সরকারি হাসপাতালের পরই পটুয়াখালী হাসপাতালের স্থান বলে জানান চিকিৎসকরা।
তাই অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার রোগীও এখানে আসেন কারণ, বেশি সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এ হাসপাতাল থেকে রেফার করে বরিশাল হাসপাতালে গিয়েছেন ৩শ ৪২ জন রোগী। অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার রোগী ছিলেন ২শ ৬৪ জন।
হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. নজরুল ইসলাম প্রথমে নিজেদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে জানালেন, ননস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, নবজাতক কেয়ার ইউনিটসহ অনেককিছু আমাদের বেশ ভালো রয়েছে। কিন্তু রয়েছে জনবল ঘাটতি। ছয়জন চিকিৎসক ইমার্জেন্সি রানিং দিচ্ছেন, এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেই না। তবু নিজেদের কাছেই মনে হচ্ছে, মানসম্মত সেবার কিছুটা ঘাটতি হয়। এজন্য বিদ্যমান সমস্যাই দায়ী। আমাদের অনেক কিছু দিয়ে অনেক কাজ করতে পারছি, কিন্তু যেসব নেই, সেজন্য সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের অ্যানেসথেসিস্ট সমস্যা প্রকট। লজিস্টিক সমস্যায় বেশি ভোগান্তিতে আছি। ওটির ঘটনাগুলোও সত্যি। ৩২ ওয়াটের বাল্ব দিয়ে কাজ সারছেন ডাক্তাররা।
‘আমি তাদের বলেছি, ঝুঁকি না নিতে। প্রয়োজনে রেফার করে দিতে। কিন্তু রোগীর স্বজনরাই অনেক সময় অপারেশনে বাধ্য করেন। কারণ, পথের দূরত্বে রোগীর আরও ঝুঁকি বাড়ার শঙ্কা থাকে। ডাক্তাররা তাই বুঝে-শুনে করছেন কাজ। ’
তিনি জানান, কয়েক দফায় ওটির সরঞ্জাম, মেরামত ও লজিস্টিক সাপোর্ট চেয়ে আবেদন করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এইডইডি-তে (হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট)। কিন্তু এখনও সাড়া মেলেনি।
ডা. নজরুল বলেন, হাসপাতালে পাঁচজন অ্যানেসথেসিস্ট থাকার কথা, আছেন মাত্র একজন। তার স্ত্রী কিছুদিন আগে ক্যানসারে মারা গেছেন। বিপর্যস্ত অবস্থায় জোর করে কাজ করানো যায় না। যতোটা সম্ভব তিনি করছেন, কিন্তু এতো রোগী, এতো অপারেশন, সে তুলনায় দুর্বল ওটি, জনবল সঙ্কট নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছি।
আপাতত টেকনিশিয়ান দেখছে কতোটা সারাই করা যায়। কিন্তু ওটির সরঞ্জামের কাজ টেকনিশিয়ান দিয়ে কতোটাইবা হবে, বলেন তিনি।
এতো সমস্যার মধ্যেও নিজেদের সাফল্যই বেশি বলে দাবি ডা. জাকিয়ার।
তিনি বলেন, এক রোগী পাঁচবার এমআর করার পর খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় এলেন। তাকে নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সফল সার্জারি হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৬
এসকেএস/এসএস