ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

সবাই ছুড়ে ফেলছে মানসিক রোগীদের

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
সবাই ছুড়ে ফেলছে মানসিক রোগীদের

ঢাকা: গত ১২ বছর ধরেই মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী বরিশালের সোহেল (২২, ছদ্মনাম)। অনেক সময় রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন।

দোকান থেকে খাবার নিয়ে দৌড়ে যান। পথে অনেক সময় মানুষের ওপর হামলা চালান। আবার অনেক সময় মানুষ বুঝতে না পেরে গণধোলাই দেয় এই যুবককে। পরিচিত কেউ দেখতে পেলে বাড়িতে দিয়ে যেতো। আবার অনেক সময় পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হতো। সমাজের এহেন আচরণে নিজের সন্তান এক সময় বোঝা হয়ে ওঠে পরিবারের কাছে।

রাজধানীর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিজের ছেলেকে ভর্তি করিয়ে পালিয়ে যান বাবা।

এভাবেই অনেক মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলে এবং মেয়েকে ছুঁড়ে ফেলছে সমাজ। তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ।

রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগরে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গেলে দেখা মেলে অসহায় এসব মানসিক রোগীর। যাদের বুঝতে পারে না সমাজ, পরিবার।
 
হাসপাতালের বহিঃবিভাগে তেজগাঁও থেকে একজন রোগীকে নিয়ে এসেছেন স্ত্রী। স্বামীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। মাঝেমধ্যেই আশপাশের মানুষকে গালাগাল দিচ্ছেন তিনি। বেশ কৌশল করেই তাকে দেখতে হচ্ছে চিকিৎসকের। ভয়ে রয়েছেন রোগী এবং অন্য এটেনডেন্টরা।
শুধু পরিবার নয়, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় এ ধরনের রোগীকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। অথচ এই রোগীদের নিরাপদে আপন ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব এই বাহিনীর। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, রোগীদের ঠিকানা দিলেও সেটি খুঁজে বের করতে অনীহা পুলিশের।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, কিছুদিন আগে কুন্তল নামে এক রোগী স্বজনহীন ছিলেন। প্রায় তিন মাস পর পরিবারের হাতে তাকে তুলে দেয়া হয়। ছোটবেলায় বাবা-মা হারিয়েছেন কুন্তল। ওর এক বোন এসেছিলেন একদিন। আর একদিন এক ভাই। কোনোরকমে খাবার দিয়েই চলে গেছেন। অপেক্ষা করেননি এক মুহূর্তও। আত্মীয়-স্বজনরাও এড়িয়ে যান।   সকলেই বোঝা মনে করেন।

এর মধ্যেই পুলিশ পুতুল নামে আরেক কিশোরীকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু পরিবার খুঁজে দিতে গড়িমসি করছে তারা।

পরিচালক বলেন, হাসপাতালে ফেলে রেখে স্বজনেরা আর খোঁজ নেন না, এমন রোগী বছরে কয়েকটা আসে। আমরা নিজেরাই অনেক সময় পৌঁছে দিয়ে আসি। না পারলে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়।
 
হাসপাতালের সমাজ সেবা কর্মকর্তা কাওসার পারভীন বাংলানিউজকে বলেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন পুতুল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বর্তমান হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের ৩ নং নন-পেয়িং বেডে রয়েছেন তিনি। পুতুলের দেয়া তথ্যানুযায়ী, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার সুমিতখোলা গ্রামের মেয়ে সে। বাবার নাম খোকন কর্মকার, মা শেফালি। ভাই পলাশও প্রতিবন্ধী। বোনের নাম স্বরস্বতি।

আবদুল হামিদ বলেন, আমরা ইতিমধ্যে শের-ই-বাংলা থানার মাধ্যমে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানাকে অবহিত করেছি। তবে এখন পর্যন্ত তার পরিবারের কোন হদিস দেয়নি থানা। এখন পুতুল স্বাভাবিক আচরণই করছে। আমরা পরিবারের জন্যে অপেক্ষা করছি।
তিনি বলেন, এই হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী এটেনডেন্ট (পরিবার বা রোগীর দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ) ছাড়া রোগী রাখা হয় না। এখানে প্রতি একজন রোগীর জন্যে একজন এটেনডেন্টের দরকার হয়। যেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নেই। ফলে নাম-পরিচয় না জানা রোগী এলে, তাকে নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। আমরা চেষ্টা করি দ্রুত পরিবারের স্বজনদের খুঁজে বের করতে।

হাসপাতালটির সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার জামাল হোসেন বলেন, এমনও ঘটনা রয়েছে, ঢাকার বাইরে থেকে পুলিশ এসে ‘রোগী বুঝিয়া পাইলাম’ মর্মে স্বাক্ষর করেছেন, অথচ রোগী রেখেই চলে গেছেন। পরে পরিচালক ওই এলাকার পুলিশ সুপারকে ফোন দিয়ে আবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীকে বাড়িতে পাঠান।
 
আব্দুল হামিদ বলেন, পরিবারগুলো আসলে হাঁপিয়ে ওঠে। দেশে এসব রোগীরর পুনর্বাসনের ভাল সুযোগ নেই। অনেকে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে যায়, আবার ফিরে আসেন। কারণ ওষুধ খাওয়ার অনিয়ম। এর মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এসব রোগীর সুস্থ রাখতে রোগীর সঙ্গে পরিবারকেও কিছু প্রশিক্ষণ প্রদান প্রয়োজন।

কাওসার পারভীন বলেন, যেসব রোগীর শেষ পর্যন্ত কাউকে পাওয়া না যায়, তারা সুস্থ হলে তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। সরকারের ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোতেও দেয়া হয় অনেক সময়।
পরিবারগুলোকে আরেকটু সহমর্মী এবং সহযোগী হতে হবে উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
এমএন/আরআই/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।