ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ফলতিতা বাজারে গোপন আস্তানায় চিংড়িতে পুশ! 

মাহবুবুর রহমান মুন্না, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
ফলতিতা বাজারে গোপন আস্তানায় চিংড়িতে পুশ!  বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারের চিংড়ি/ছবি: বাংলানিউজ

বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা বাজার থেকে ফিরে: ভ্যান-ট্রাক-পিকআপ-মাহেন্দ্র ভরে দূর-দূরান্ত থেকে আসছে চিংড়ি ও সাদা মাছ। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাদা মাছ। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গলদা আর বাগদা চিংড়ি। পাইকারি ও খুচরা হাজারও ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁক-ডাক ও দর কষাকষিতে তাই দিনভরই মুখরিত বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা বাজার। 

খুলনা-বাগেরহাট-মাওয়া মহাসড়কের পাশে বাগেরহাটের ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারটি দেশের সর্ববৃহৎ চিংড়ির পাইকারি বাজার হিসেবেই পরিচিত।  

ডাকের মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে আড়ৎদারদের মাধ্যমে চিংড়ি বিক্রি হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে।

চিংড়ি কিনে তার ওজন বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিকসহ নানা অপদ্রব্য পুশ করে থাকেন এসব পাইকারী ব্যবসায়ী।  

শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে বাংলানিউজের বিশেষ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মিনি কুয়েত খ্যাত দেশের সবচেয়ে বড় চিংড়ি বিপণন কেন্দ্র ফকিরহাটের ফলতিতায় বিকেল ৫টার পর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলছে বিভিন্ন অপকৌশলে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশিংয়ের কাজ। গোপন আস্তানায় গ্যাসের সিলিন্ডার ও চুলা ব্যবহার করে ক্ষতিকর পাউডার ও আঠা দিয়ে জেলি তৈরি করা হচ্ছে। এসব জেলি সিরিঞ্জ দিয়ে চিংড়ির ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে। ডিপোর পেছনের ঘরে তালা লাগিয়ে নারী ও শিশু শ্রমিকরা এই ক্ষতিকর গরম জেলি চিংড়িতে প্রয়োগ করছে। ক্ষতিকর গরম জেলি তরল অবস্থায় সিরিঞ্জ দিয়ে চিংড়ির ভেতরে ঢোকানোর পরে বরফের পানিতে ভিজিয়ে শক্ত করা হচ্ছে একদিকে। শক্ত হওয়ার পরে এগুলো প্যাকেটজাত করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হবে।  
ফলতিতা বাজারে গোপন আস্তানায় চিংড়িতে পুশ!
বাইরে তালা ভিতরে পুশিং
ফলতিতা বাজারের সাইনবোর্ড বিহীন বিভিন্ন দোকানে ও আশপাশের এলাকার গোপন আস্তানায় ঘরের বাইরে তালা লাগিয়ে ভিতরে শ্রমিকরা চিংড়িতে পুশ করে। দিনের পর দিন কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো নজরদারিতে চৌকস কর্মীদের বসিয়ে রেখে মাছ ঘরের বাইরে থেকে তালা দিয়ে ভেতরে সারিবদ্ধভাবে হাতে ইনজেকশনের সুচ-সিরিঞ্জ ও গামলা ভর্তি অপদ্রব্য নিয়ে শ্রমিকরা নিয়োজিত থাকছে পুশ কার্যক্রমে।

প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলে পুশ
দিনের পর দিন লাগামহীনভাবে গলদা ও বাগদা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশিং করার প্রক্রিয়া চলছে। তাদের কারণে যারা সৎ ব্যবসায়ী তারাও বেকায়দায়। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ না থাকলেও দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক চুক্তিতে মাসোয়ারা আদায়ের একাধিক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে পুলিশসহ উপজেলা মৎস্য অধিদফতর ও উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। বছরে দু'একবার র‌্যাব-পুলিশসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হলেও, কম লোকবল বা সংশ্লিষ্ট দফতরের মধ্যে আর্থিক সুযোগ নেওয়া গুটিকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে আগে থেকেই অভিযানে বের হওয়ার খবর পৌঁছে যায় ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীদের পুশিং কার্যক্রমের দেখা পাওয়া যায় না।
ফলতিতা বাজারে গোপন আস্তানায় চিংড়িতে পুশ! যাদের বিরুদ্ধে পুশিংয়ের অভিযোগ
বাজারের ডিপো, গোয়াল ঘর, ঘেরের ঘর ও বিভিন্ন বাড়িতে নোংরা পরিবেশে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয়। প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা আয় হওয়ায় অনেকেই এ অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে এ অপকর্মে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারের কিরণ, লিটন, সোহাগ, মোস্তফা ওরফে মোস্ত ও ব্যবসায়ী সমিতির প্রভাবশালী কয়েক নেতা।  

ইতিমধ্যে পুশের দায়ে বিগত দিনে প্রশাসনের কাছে হাতে নাতে ধরা খেয়েছেন ফলতিতা বাজারের ওবায়দুর রহমানের আড়ৎ এর কর্মচারী শাহ জালাল সরদার। বায়েজীদ ফিশের মালিক বায়েজীদ মোড়ল, বৃষ্টি ফিশের মালিক মো. কুতুব তরফদার, ফেমা ফিশের মালিক মো. নিজাম উদ্দিন,  অন্তরা ফিশের মালিক নন্দ কুমার, ঠান্ডা-মাসুদ-জুয়েল ফিশের মালিক মো. জুয়েল, শাপলা ফিশের মালিক আজাহার শিকদার, উলবি আইস প্লান্টের মালিক মো. ওহাব, যাত্রাপুর অ্যান্ড লখপুর মৎস্য আড়তের মালিক জাহিদ শেখ, খানজাহান আলী ফিশের মালিক শাহাবুদ্দিন মোল্লা, মেসার্স জিনিয়া ফিশের মালিক এনামুল হককে বিভিন্ন অংকের আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে।  

যেসব স্থানে পুশ করা হয়
ফলতিতা বাজার ছাড়াও পাশের যেসব এলাকায় চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয় সেগুলো হলো- মাটিয়ার গাতি, বানিয়া খালি, মায়ার খালি, রুদ্র গাতি, কলকলীয়া, গোয়াল বাড়ি, পুটিয়া, মূলঘর, খাজাডাঙ্গা।  

যেখান থেকে মাছ আসে ও যেখানে যায়
বাগেরহাটের ৯ উপজেলা, খুলনার ৯ উপজেলা, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলার চাষিদের মাছ এ বাজারে আসে।

ডিপোগুলোতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার পর তা ট্রাকে করে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ফেনী, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী মাছ কোম্পানিতে বিক্রি করা হয়। এসব মাছ পিকআপ, ট্রাক ও রোহান পরিবহনের বক্সে ও ছাদে ওইসব স্থানে যায়।
ফলতিতা বাজারে গোপন আস্তানায় চিংড়িতে পুশ! দেশে ও বিদেশে চিংড়ির মান নিয়ে প্রশ্ন
চিংড়ি মাছে বিভিন্ন অপদ্রব্য পুশ করা অব্যাহত থাকায় দেশে ও বিদেশে চিংড়ির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিদেশের বাজারে দেশের ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কয়েকটি চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিদেশে চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে দাম পড়তে শুরু করেছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে সাদা সোনা খ্যাত দেশের দ্বিতীয় রফতানি পণ্যটি।

এক চিংড়িতে দুই বার পুশ
স্থানীয় ফড়িয়া ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা উৎপাদনকারী ঘের মালিকদের কাছ থেকে চিংড়ি কিনে তার ওজন বৃদ্ধির জন্য রাসায়নিকসহ নানা অপদ্রব্য পুশ করে থাকে। আবার আড়তে বিক্রি করতে আনা চিংড়িগুলো কিনে আড়তের আশপাশের গোপন ঘরে বসেই পুশ করা হয়। এভাবে এক চিংড়িতে দুই বার পুশ করা হয়। যাকে বলা হয় হার্ট পুশ। এক কেজি চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করায় প্রতি কেজিতে ২ থেকে আড়াইশ’ গ্রাম ওজন বৃদ্ধি পায়।  

লোকসানে চাষিরা
অপদ্রব্য পুশ করে অসাধু ব্যবসায়ীরা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হলেও লোকসানে স্থানীয় চিংড়ি চাষীরা। গত বছর ১২০০ টাকার বড় গ্রেডের চিংড়ির বর্তমান দাম ৮০০-৯০০ টাকা। মাঝারি গ্রেডের যেসব চিংড়ি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বর্তমানে সেগুলোর দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ছোট গ্রেডের চিংড়ি গত বছর ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। চাষীরা জানান, মাঝারি গ্রেডের প্রতি কেজি চিংড়ি উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। সেই সঙ্গে রয়েছে ঘেরে মাছের খাবার, শ্রমিকের মজুরি, জমির মালিকের হাঁড়ির টাকা ও আনুষঙ্গিক খরচ।

কলকলীয়া গ্রামের খোকন বিশ্বাস নামের এক চিংড়ি চাষী জানান, গেল বছর অতিবৃষ্টিতে মাছ ভেসে গেছে।

এছাড়া পুশের কারণে বিশ্ব ও দেশিয় বাজারে চিংড়ির দাম কমে যায় চিংড়ি চাষ করে লোকসান গুণতে হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার খেসারত দিতে হয় সাধারণ চিংড়ি চাষিকে।

মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা লাভবান
চিংড়িতে পুশের কারণে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ফড়িয়া ও কিছু পাইকারী ব্যবসায়ী লাভবান হলেও চিংড়ি শিল্পকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাইকারী চিংড়ি ব্যবসায়ী বলেন,  বাজারের প্রায় দুই শত মাছ ঘর  থেকে প্রতি মাসে পুলিশ ও মৎস্য অফিসে টাকা দিতে হয়। তা না হলে বিভিন্ন অযুহাতে আড়ত বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়। রাস্তায় গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। এ টাকা উঠাতে মাঝে মধ্যে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হয়।  
ফকিরহাট ফলতিতা মৎস্য আড়ৎদার সমিতির সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম পপলু পুশের অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, বাজারে অপদ্রব্য পুশ করা হয় না। তবে আশপাশের বিভিন্ন স্থানে হয় বলে শুনেছি।

সাঁড়াশি অভিযানের দাবি
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার কো-অর্ডিনেটর অ্যাডভোকেট মমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, কয়েক বছর আগে চিংড়িতে পেরেক ঢুকিয়ে ওজন বৃদ্ধি করার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিশাপ মোচন করা গেলেও এখন চলছে জেলি ও সাগুদানা নামক অপদ্রব্য পুশ করার রমরমা বাণিজ্য। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব কারণে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি বিদেশের বাজারে সুনাম হারাচ্ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও অতি মুনাফালোভীর কারণে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা রোধ করা না গেলে চিংড়ি রফতানিতে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে।  তিনি পুশ বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের দাবি জানান।  

র‌্যাব-৬’র স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, পুশ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েছি। তাদেরকে ধরে জেল-জরিমানা করে মাছ বিনষ্ট করেছি।  

বাংলাদেশ সময়:  ২০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
এমআরএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।