ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

শিশুস্বাস্থ্য ও শিশুপুষ্টির করুণ দশা

মাজেদুল নয়ন; স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১১
শিশুস্বাস্থ্য ও শিশুপুষ্টির করুণ দশা

ঢাকা : দেশে শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির অবস্থা রুগ্ন। অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৮০লাখ শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটছে না।

২০০৯ সালে  জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচএন), ইউনিসেফ ও ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) এর উদ্যোগে জাতীয়ভাবে পরিচালিত সর্বশেষ ‘স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি জরিপ’ অনুসারে বর্তমানে শূন্য থেকে ৫ বছরের কম বয়সী ৬০লাখ শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজন, ৭৮লাখ শিশু বয়সের তুলনায় বেঁটে ও ২লাখ ২০হাজার শিশু উচ্চতার তুলনায় কম ওজনের। তবে এ সব শিশুদের মধ্যে অনেকে একাধিক সমস্যায় ভুগছে। দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ১কোটি ৬৮লাখ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানদণ্ডের সূচক অনুসারে একটি দেশে শতকরা ৪০ভাগ বয়সের তুলনায় বেঁটে, শতকরা ৩০ভাগ বয়সের তুলনায় কম ওজন ও শতকরা ১৫ভাগ উচ্চতার তুলনায় কম ওজন হলে মারাত্বক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। সূচক হিসেবে সবকটি ক্ষেত্রেই নীচে রয়েছে বাংলাদেশ।

প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান জানান, জম্মের পর পরবর্তী দুই বছর বয়সের মধ্যেই শিশুটির ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়ে যায়। আর এ সময়ে গুণগত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে পরিবারগুলোতে শিশুদের সঠিক খাবার খাওয়ানোর চর্চা হচ্ছে না। তিনি বলেন, শুধু দরিদ্র পরিবারেই নয়, প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এমনকি ধনী পরিবারের শিশুরাও অপুষ্টিতে ভোগে ও বিভিন্ন সমস্যার কারণে মারা যায়।

বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের (বিবিএফ) সভাপতি ও আইসিডিডিআরবি’র সিনিয়র বিজ্ঞানীয় পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. এস কে রয় বলেন, জম্মের সাথে সাথেই এক ঘন্টার মধ্যে নবজাতককে শালদুধসহ মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, প্রথম ৬মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো, শিশুর বয়স ৬ থেকে ২৪মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি  যথাযথ পরিমাণে বয়সোপযোগী বাড়তি খাবার (খাবারের পরিমাণ, গুণগত মান, বিভিন্ন ধরনের ও চাহিদাভিত্তিক খাদ্য) ও ৬মাস থেকে ২৪ মাস বয়সী শিশুর খাবার তৈরি ও খাবার তৈরির আগে হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ জ্ঞানের অভাবই অপুষ্টির প্রধান কারণ।

তিনি জানান, দেশে শতকরা মাত্র ৪৩ জন শিশু ছয়মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ পায়। অধিকাংশ মা দুমাস পর দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়। অপুষ্টির শিকার মাও শিশুকে দুধ খাওয়াতে পারে এ সাধারণ তথ্য পরিবারের সদস্যদের অজানা থাকায় শিশুকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়।

যতদিন পর্যন্ত নবজাতক শিশুদের ছয়মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো ও ছয়মাসের পর থেকে শিশুর প্রয়োজনীয় বাড়তি গুণগত মানসম্পন্ন খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে না উঠবে ততদিন পর্যন্ত দেশে সার্বিক শিশু পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি না হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লাগাম টেনে ধরেছে।

তারা জানান, অপুষ্টির কারণে শিশুরা দেরিতে পড়তে, লিখতে শেখে। স্কুলে যেতেও বিলম্ব হয়। আচরণগত বিকাশও দেরিতে ঘটে তাদের। অপুষ্টির কারণে যে সকল মেয়ে বেঁটে হয়, তারা অপক্ষোকৃত ছোট ও কম ওজনের নবজাতক জম্ম দেন। বংশ পরিক্রমায় এ ধারা অব্যাহত থাকে।  

তারা বলেন, জন্মকালীন ওজনস্বল্পতা,শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা, জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শালদুধ না খাওয়ানোর ফলে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, মিজেলস্, ইনজুরি ও অন্যান্য  বিভিন্ন কারণেপাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর অকাল মৃত্যুর হয়। এ ছাড়াও খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতা, বসবাসস্থল ভাল না হওয়া, পরিষ্কার পরিছন্নতার অভাব, অনিরাপদ পানি পান ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অভাবও শিশুর অপুষ্টির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা ।

ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি ফর ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং ইন বাংলাদেশ এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩লাখ ৮৩হাজার শিশু মারা যায়। জন্মের ২৮দিনের মধ্যে ১লাখ ২০হাজার ও জন্মের সময়ে শ্বাস প্রশ্বাসজনিত সমস্যায় প্রায় ২৪হাজার নবজাতকের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ২লাখ ৮৭ হাজারেরও বেশী শিশু এক বছরের মধ্যে মারা যায়। শতকরা হিসেবে ৫৭ভাগ জম্মের ২৮দিনের মধ্যে এবং শতকরা ২৩ভাগ এক মাস  থেকে ১২ মাসের মধ্যে মারা যায়।

ইউনিসেফের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা.মো.মোহসীন আলী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মানদণ্ডের সূচক অনুসারে দেশে পাঁচ বছরের নীচের শিশুপুষ্টির চিত্র হতাশাব্যঞ্জক। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেলেও তা হচ্ছে খুবই ধীরগতিতে। সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে জাতীয়ভিত্তিক প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপ ২০০৭ অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৪০লাখ। দেশের মোট শিশুর মধ্যে প্রতি হাজারে মৃত্যুহার পাঁচ বছরের কম বয়সী  ৬৫, এক বছরের কম বয়সী ৫২ ও নবজাতক (২৮দিনের মধ্যে)৩৭জন।

শিশু পুষ্টি সমস্যা প্রকট হলেও বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে দেশের এক চতুর্থাংশ এলাকায় জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচি চলছে। এনএনপি ছাড়াও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানও সীমিত পর্যায়ে পুষ্টি নিয়ে কাজ করছে।

এনএনপির নির্বাহী পরিচালক মাইনুদ্দিন খন্দকার বলেন, এনএনপি সীমিত পর্যায়ে পরিচালিত হলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার পুষ্টি পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ মহিলাদের আত্ননির্ভরশীল করে তুলেছে এ প্রকল্প।  

ব্রাকের উপ-পরিচালক পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা.মো. রাইসুল হক বলেন, সীমিত পর্যায়ে পুষ্টি নিয়ে কাজ হলেও জাতীয়ভাবে পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। তিনি জানান, পুষ্টি সম্পর্কিত সঠিক তথ্য মায়েদের কাছে পৌছাচ্ছে না। সঠিক তথ্য পেলে মায়েরা শিশুদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান এর প্রমাণ মাঠ পর্যায়ে পাওয়া গেছে।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক প্রফেসর ডা. ফাতেমা পারভীন চৌধুরী বলেন, অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় গত তিন বছরে সারাদেশে পুষ্টি বিষয়ে সফল কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মানুষ নতুন করে পুষ্টি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে শিখছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. খন্দকার মো.শিফায়েত উল্লাহ বলেন, এনএনপি কিংবা আইপিএইচএন কাঙ্ক্ষিত জাতীয় পুষ্টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারে নতুন চিন্তাভাবনা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘন্টা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।