মেয়েদের জীবনে ঋতু বা মাসিক একটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু পরিষ্কার পানি, উপযুক্ত স্যানিটেশন সুবিধা এবং আনুষঙ্গিক স্বাস্থ্যবান্ধব সুযোগ-সুবিধার অভাব মাসিক স্বাস্থ্যের ব্যবস্থাপনাকে কঠিন করে তুলছে।
প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য, মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং জীবনদক্ষতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জাতীয় কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে ‘ঋতু’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছে ইউনিসেফ, ব্র্যাক, ওয়াটারএইড, আইসিডিডিআরবি, বিএনপিএসসহ ৩৫টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্ল্যাটফর্ম।
নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের অর্থায়নে সিমাভির সহায়তায় পরিচালিত ‘ঋতু’ প্রকল্পটি যৌথভাবে বিএনপিএস, ডরপ, রেড অরেঞ্জ, টিএনও এবং এমএইচএম বাস্তবায়ন করছে। ওই প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালে নেত্রকোনা জেলায় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক বেজলাইন সার্ভে করা হয়। যেখানে জেলার ১৪৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪ হাজার ৪৬ জন মেয়ে শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
ওই সার্ভে প্রতিবেদন অনুযায়ী, টয়লেটের ভেতরে বা কাছাকাছি সাবান-পানির কোনো ব্যবস্থা না থাকা, নিরাপদ পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ না থাকা, টয়লেটের দরজা, ছিটকিনি, তালা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য প্রাচীর ঠিকমতো না থাকা, টয়লেট পরিচ্ছন্নতার টেকসই ব্যবস্থার অভাব, পর্যাপ্ত আলো না থাকা, ঢাকনাযুক্ত কন্টেইনার, মাসিকের উপকরণ অপসারণের টেকসই ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে ৭৫ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসিকের সময় স্কুলের টয়লেটে যায় না। আর ৫৩ শতাংশ মেয়েশিক্ষার্থী মাসিকের সময় কমপক্ষে তিনদিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। আর ৯১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসিকের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে। মাত্র ৩৬ শতাংশ মেয়ে প্রথম মাসিকের আগে স্বাস্থ্যবিধি জানে।
ইউনেস্কোর মতে, মাসিক স্বাস্থ্যের জন্য বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত শিক্ষা, মাসিক সংক্রান্ত উপকরণ, সাবান, পানি, নিরাপদ টয়লেট ও বর্জ্য ফেলার উপযুক্ত জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু সীমিত সম্পদ, বিদ্যমান অবকাঠামো এবং যথাযথ উদ্যোগের অভাবে অনেক স্কুলেই এসব সুবিধা থাকে না। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন-এর তথ্যানুযায়ী মাত্র ৪৪ শতাংশ বিদ্যালয়ে স্যনিটারি ন্যাপকিন রাখার আলাদা জায়গা রয়েছে। স্কুলগুলোতে পানি ও স্যানিটেশনের স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনার অভাব প্রকট। ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মাসিকের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ মেয়েশিক্ষার্থী মাসিককালে স্কুলে যায় না এবং প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মনে করে মাসিকের সমস্যা স্কুলের কর্মকাণ্ডে তাদের স্বাভাবিক অংশগ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
এমতাবস্থায় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ২০১৫ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবান্ধব টয়লেট ও মাসিকের সময় প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাদের মতে, এ বিষয়ে বাজেট বরাদ্দসহ মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সেক্টর উন্নয়ন পরিকল্পনা (এসডিপি) ২০১১-২০২৫ এর নির্দেশনা অনুসারে, টয়লেট ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১৮৭ জনের পরিবর্তে ১:৫০ জন করা এবং নতুন পৃথক টয়লেট তৈরি ও পরিচালনার জন্য বাজেট বরাদ্দে অবশ্যই স্কুলকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ওইসব সুপারিশের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বিএনপিএস’র নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য সঠিক ও ব্যাপক তথ্যের সম্প্রসারণ এবং মাসিক অনুকূল সেবা প্রদানমূলক পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শারীরিক শিক্ষা এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ে বয়ঃসন্ধিকাল, ঋতুস্রাব, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলো থাকলেও সেখানে তথ্যের অপর্যাপ্ততা ও যুক্তিসিদ্ধ বিন্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এমনকি মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। তাই পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস এবং পাঠ্যপুস্তকে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও যৌনশিক্ষা বিষয়ক পাঠ যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইসরাত জাহান ইলা বলেন, মাসিক স্বাস্থ্য যেহেতু যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যেরই একটি অংশ। তাই মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিককে স্বাস্থ্যসম্মত ও ইতিবাচক হিসেবে দেখার পরিবেশ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে এটি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে মেয়ে শিশুর প্রথম মাসিকসহ মাসিককালে সব নারী তাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সহযোগিতা পায়। এছাড়া মাসিকের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনা যেন কিশোরী ও নারীদের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাধাগ্রস্থ না করে, সে বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৯
এসএম/আরআর