হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) গত বছর উদ্বোধন করা হলেও তা এখনও চালু হয়নি, হাসপাতালে সরকার প্রদত্ত ওষুধ দেওয়া হয় না সব রোগীকে। এ হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্যও অনেক বেশি।
২০১৫ সালে সরকারি টিবি (টিউবারকুলেসিস) ক্লিনিকটিকে বিশেষায়িত যক্ষ্মা হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৫০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আন্তঃবিভাগ সেবা চালু হয়। যদিও নামে ২৫০ শয্যা এবং তা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও অজানা কারণে হাসপাতালের বেডের সংখ্যা এখনও বৃদ্ধি পায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, এই প্রক্রিয়া আরও ধীরে ধীরে হবে।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর যন্ত্রপাতির অভাবে এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হতো না বলে রোগীর সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই ঘাটতি না থাকায় রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এছাড়া এখানে চালু হয়েছে অ্যাজমা সেন্টার, যেটা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ইনডোরে গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। যার বেশিরভাগই ফ্রি বেডে থাকেন। সরকারের নিয়ম অনুসারে ৬০ ভাগ রোগীর চিকিৎসা খরচ নেওয়া যাবে না। এছাড়া ৯০টি বেডের ক্ষেত্রে বেড ভাড়া ও খাওয়ার খরচসহ ২৭৫ টাকা প্রতিদিন দিতে হয় রোগীকে। আর ৪২টি কেবিন রয়েছে যার দিন প্রতি খরচ ১ হাজার ১২৫ টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফ্রি বেড খালি না থাকলেও খরচসহ বেডগুলো প্রায় খালি। সেখানকার চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীদের তেমন অভিযোগ না থাকলেও আউটডোরের রোগীদের অভিযোগ রয়েছে।
রামীম নামের এক রোগী বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রথমদিন হাসপাতালে যথাসময়ে আসার পরও চিকিৎসা পাইনি। আজ আবার এসেছি। কিন্তু প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে বসে থেকেও এখনও এক্সরে করাতে পারিনি। যেটা নিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে। এখানে ডাক্তার কিংবা টেকনিশিয়ানরা থাকলেও তারা অনেক ধীর গতিতে কাজ করে, এমনকি রোগীদের ফিরিয়ে দেয়।
এছাড়া রয়েছে সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের ওষুধ রোগীদের না দেওয়ার অভিযোগ। আবার ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সকাল থেকেই হাসপাতালে রোগীদের প্রেসক্রিপশন চেক করতে দেখা গেছে। হাসপাতালের নতুন ভবনে ডাক্তার দেখিয়ে পুরনো ভবনে অবস্থিত ফার্মেসিতে যাওয়ার পথে দুই ভবনের সংযোগস্থলে তারা অবস্থান করেন। যেখানে সরকারি নিয়মানুসারে বেলা ১২টার আগে এই ওষুধ রিপ্রেজেন্টেটিভরা হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারবে না। এসব ওষুধ রিপ্রেজেন্টেটিভদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসকদের দেওয়া বড় মাপের অফারগুলো চেক করতে তারা এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। যে অফারের কারণে চিকিৎসকরা ওই কোম্পানির ওষুধগুলো প্রেসক্রাইব করেন। আর রোগীদেরও এ পথ দিয়ে যেতেই হয়।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. মোশারফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রোগীরা চায় সবসময় ফ্রি বেডে থাকতে। যে কারণে আমাদের হাসপাতালের উপার্জন কম হয়। আমরাও অন্যান্য বিশেষায়িত হাসপাতালের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি না। তবে আমাদের অ্যাজমা সেন্টারটা বেশ জনপ্রিয়। বক্ষব্যাধি থেকে আমাদের এখানে রোগী আসে বেশি। আমাদের মেডিকেল অফিসারদের বাইরে বিশেষজ্ঞরাও রোগী দেখেন। আর সরকারি নিয়মানুসারে ওষুধ কোম্পানির লোকদের নিষেধ করলেও তারা শোনে না।
এসময় একজন রোগী এসে এই চিকিৎসকের কাছে ফার্মেসি থেকে ওষুধ না দেওয়ার অভিযোগ করলে ডা. মোশারফ বলেন, ওষুধ এখানে আছে। আমি বলে দিচ্ছি।
এরপর ওই রোগী ওষুধ পান। তবে এ বিষয়েও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এদিকে গত বছরের ২২ অক্টোবর হাসপাতালটিতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আইসিইউ, এইচডিইউ ও ভেন্টিলেটর, অপারেশন থিয়েটার উদ্বোধন করেন। তবে এখনও চালু হয়নি আইসিইউ, যদিও চালু রয়েছে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ)। আইসিইউ’র বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে অনেক। জানা গেছে, আইসিইউ’র জন্য বাজেটের টাকা থেকে মেশিন কিনলেও বাকি টাকার কোনো হদিস নেই।
এ বিষয়ে আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. মোশারফ হোসেন বলেন, আমাদের জনবলের অভাবে আইসিইউ চালু করতে পারছি না।
অন্যদিকে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও উপ-পরিচালক ডা. মো. আবু রায়হান বলেন, আমাদের জনবলের অভাব নেই। যে জনবল আছে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আবার এক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রয়োজনও।
এক্ষেত্রে কারও কাছ থেকে সঠিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আবার হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশিরভাগেরই স্থায়ী নিয়োগ বা চাকরি সরকারিকরণ হয়নি। যেখানে চিকিৎসকরাসহ ৫০ জন নার্স এবং ১৫ জন কর্মচারী রয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এ কারণে প্রতি বছর সরকারের হিসাবরক্ষণ বিভাগে (এজি) বেতন তোলার সময় প্রতি বছর চাকরি রিটেনশন করা লাগে। আর এ কারণে বড় একটি অঙ্ক ঘুষ দিতে হয়। তাছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই এজি অফিসে প্রতি মাসে প্রতিজনের বেতন তোলার জন্য প্রতি স্লিপে ১৫০ টাকা ঘুষ বাবদ ব্যয় করতে হয়। যেখানে সরকার নির্ধারিত খরচ ১০ টাকা। সব মিলিয়ে হাসপাতালের উপার্জিত অর্থের একটি অংশ সরকারের আরেক মন্ত্রণালয়কে দিতে হয়।
সামগ্রিক বিষয়ে শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও উপ-পরিচালক ডা. মো. আবু রায়হান বাংলানিউজকে জানান, আমাদের হাসপাতালে ওষুধের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত বাজেট দেওয়া হয় না। তাই ওষুধের সংকট থাকে। আমরা ইনডোরে আগে ওষুধ নিশ্চিত করি এরপর আউটডোর। একারণে অনেক সময় ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না। আর ওষুধ কোম্পানির লোকদের অনেক নিষেধ করি ১২টার আগে না ঢুকতে। কিন্তু তারা জোর করে ঢুকে যায়। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।
রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়টিও তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।
চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, অনির্দিষ্ট কারণে এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। এটার সুরাহা কবে হবে তা বলতে পারছি না।
বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৯
এমএএম/আরআর