এতক্ষণ যে চিত্রের বর্ণনা দিচ্ছিলাম, তা ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান চিত্র। রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া তো দূরের কথা, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিজেই যেনো এক রোগী।
গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০০ রোগী ৩১ শয্যার এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। তবে হাসপাতালের এ বেহাল দশায় চিকিৎসাসেবার পরিবর্তে রোগীদের পোহাতে হয় দুর্ভোগ।
২০০২ সালে ফুলগাজী উপজেলার পুরোনো মুন্সিরহাট বাজারে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চালু হয়। এখানে নয়টি চিকিৎসক পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবার দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ফলে চারজন চিকিৎসক দিয়েই চলছে এ হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম।
অন্যদিকে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে প্রেষণে ঢাকার একটি হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন এ হাসপাতালের এক্স-রে টেকনিশিয়ান। ফলে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সচল দু’টি এক্স-রে যন্ত্র বর্তমানে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। পাশাপাশি দন্ত বিভাগের টেকনিশিয়ানও বিগত ১২ বছর যাবৎ প্রেষণে ঢাকায় কর্মরত। আর দীর্ঘদিন ধরে শূন্যই রয়েছে প্যাথলজি ল্যাব টেকনিশিয়ানের পদটি।
হাসপাতালের এ বেহাল দশায় রোগীদের অতি প্রয়োজনীয় এক্স-রে ও অন্যান্য সাধারণ পরীক্ষাগুলো অধিক মূল্যে করাতে হচ্ছে বাইরে থেকে। এছাড়া গত ১৭ বছরেও হাসপাতালে অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ) ও জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তার (ইএমও) পদই সৃষ্টি হয়নি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত রয়েছেন পাঁচজন চিকিৎসক। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ থাকায় হাসপাতালে আসছেন না উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। অন্য চারজনের মধ্যে একজন ডেন্টাল সার্জন। তিনি শুধু দাঁতের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেন। অন্যদিকে একজন গাইনি বিষয়ক জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং দু’জন চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমও) অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগের রোগী দেখেন। পাশাপাশি গাইনি চিকিৎসককেই আবার হাসপাতালের প্রশাসনিক কাজকর্মও দেখাশোনা করতে হয়।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে আরও জানা যায়, অবেদনবিদ ও জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তা না থাকায় হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার (ওটি) থাকলেও তা অযত্নে পড়ে রয়েছে। ফলে সেটা জরুরি কিংবা প্রসূতি রোগীদের কোনো কাজে আসছে না।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা বাংলানিউজকে জানান, দীর্ঘদিন থেকেই এ হাসপাতালে একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), দুইজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন ও সার্জারি) ও একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা- এ চারটি পদ শূন্য রয়েছে।
অন্যদিকে উপজেলায় তিনটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং তিনটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের (এফডব্লিউসি) প্রতিটিতে একজন করে মোট ছয়জন চিকিৎসা কর্মকর্তার (এমও) পদ থাকলেও বর্তমানে সেগুলোর সবগুলো পদই শূন্য। বিভিন্ন ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এমবিবিএস পাস চিকিৎসা কর্মকর্তা (এমও) না থাকায় কমিউনিটি মেডিকেল অফিসাররাই সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য ভরসা হয়ে উঠেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এক্স-রে ও অন্যান্য অনেক পরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকে। এক্স-রে সুবিধা না থাকায় দুর্ঘটনায় আহত রোগীদেরও চিকিৎসাসেবার জন্য বাইরে নিয়ে যেতে হয়। এছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। অনেক সময় রোগীদের নির্ভর করতে হয় উপ-সহকারী চিকিৎসা কর্মকর্তার ওপর।
হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুন নাহার বাংলানিউজকে জানান, সাধারণ রোগী দেখার পাশাপাশি তাকে হাসপাতালের দাফতরিক কাজও করতে হয়। তবে গাইনি বিশেষজ্ঞ হলেও অবেদনবিদ না থাকায় তিনি প্রসূতিদের সিজারিয়ান অপারেশনসহ জরুরি চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন না।
তিনি আরও জানান, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ২০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। ৩১ শয্যার এ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ২৫ জন রোগী ভর্তি থাকেন। চিকিৎসকসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মচারী স্বল্পতার বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো সমাধান মেলেনি।
ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. হাসান মো. নিয়াতুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও কর্মচারী সংকটের বিষয়টি আমি জানি। এ নিয়ে আমি নিজেও স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৯
এসএইচডি/এসএ