খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে অন্যসব ইনসুলিনের তুলনায় মর্ডান ইনসুলিনের দাম কিছুটা বেশি। তাই কিছু বিদেশি কোম্পানির মর্ডান ইনসুলিনের নকল বাজারে পাওয়া যায়।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি ইনসুলিন তৈরি করছে। কিন্তু এসব ইনসুলিনের কোনো বায়ো ইকুইভেলেন্স (পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো) পরীক্ষা নেই। এমনকি এটি কত মাত্রায় ব্যবহার করা হলে ব্লাড সুগার কতটা নিয়ন্ত্রণ হবে সে বিষয়েও কোনো গবেষণা নেই। আবার এসব কোম্পানি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের ইনসুলিন ব্যবস্থাপত্রে লিখতে চিকিৎসকদের বাধ্য করছেন। এমনকি তারাই বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করছেন। ফলে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, বিদেশি কোম্পানির মর্ডান ইনসুলিনগুলোর নকল পাওয়া যায় দেশের বাজারে। তবে এক্ষেত্রে সেটি নির্ণয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ ওইসব কোম্পানি একেক দেশের জন্য একেকটি নির্দিষ্ট ব্যাচ তৈরি করে। লাগেজে করে যেসব ইনসুলিন আনা হয়, সেগুলো বিক্রির আগেই কোল্ড চেইন না মানায় নষ্ট হয়ে যায়। দেশি কোম্পানির ইনসুলিনের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশি কোম্পানির ইনসুলিনের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাই এসব ইনসুলিন নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন।
এ ধরনের ইনসুলিন ব্যবহারে রোগীদের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইনসুলিন নকল বা মানহীন হলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের মৃত্যু হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীরে এলার্জির প্রভাব বাড়তে পারে। চুলকানি, ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এমনকি নানা ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ঠ উদ্যোগী এবং বিভিন্নমাত্রায় সফল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। অর্থাৎ বাংলাদেশের ডায়াবেটিস রোগীরা তুলানমূলক খারাপ অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। এযাবৎকালে প্রকাশিত দু’টি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের ২০ শতাংশের কম রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সফল। এটিই বর্তমান বিশ্বের যেকোনো দেশের ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাত্রার তুলনায় খারাপ অবস্থা। ডায়াবেটিসের দীর্ঘকালীন জটিলতাগুলোতেও বাংলাদেশি রোগীরা বেশি ভুগছেন। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি হলো, এখানে অতি অল্প বয়সে মানুষ (ছেলে-মেয়েরা) টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরী ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে। বাংলাদেশের আরও একটি বড় ঝুঁকি হলো- বিপুল সংখ্যক গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগী, পৃথিবীতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ কোটিরও বেশি। ডায়াবেটিস যেহেতু বহুলাংশেই (৮০ ভাগ পর্যন্ত) প্রতিরোধযোগ্য, ফলে এখনই যদি এ রোগের প্রতিরোধ না করা যায়, তাহলে এই সংখ্যা ২০৪০ সাল নাগাদ প্রায় ৬৪ কোটিতে পৌঁছানোর আশংকা করছে সংস্থাটি। আইডিএফ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৩ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। তাছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এমন অর্ধেকেরও বেশি লোক জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিশ্বের ১৭০টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ডায়াবেটিস সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টিই ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’র প্রধান লক্ষ্য। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘আসুন, প্রতিটি পরিবারকে ডায়াবেটিসমুক্ত রাখি’। দিবসটি উপলক্ষে সারাদেশে ডায়বেটিক সমিতিসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন আয়োজন রেখেছে।
এদিকে ডায়াবেটিক সমিতির উদ্যোগে দেশের ৪শ উপজেলায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কিনা জানেন না, এমন লোকদের ওপর গবেষণা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে এদের মধ্যে প্রতি চার জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সিলেট বিভাগে কম। এর আগে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এবং শহুরে দরিদ্র লোকদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার কম দেখা গেলেও এই গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানে সেই হার প্রায় একই রকম। তাছাড়া বাংলাদেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ২৬ শতাংশ। গর্ভ পরবর্তী এক বছরের মধ্যে এদের ১৫ শতাংশ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। গর্ভকালীন চিকিৎসায় নিয়োজিত ৪৮ ভাগ চিকিৎসক এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৯
এমএএম/জেডএস