তারা বলছেন, আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে অনেক দুর্বলতা আছে, সেইসঙ্গে তথ্য গোপনেরও একটা প্রবণতা আছে। আর তথ্য গোপন করলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণেও সমস্যা হয়।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন রোগীর মৃত্যু হয়। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ১২৩১ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪৯ জন। আর মারা গেছেন ৫০ জন।
করোনা সংক্রমণে প্রকৃত মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার (১৫ এপ্রিল) আইইডিসিআরের করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত বুলেটিনের পর ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার মো. আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘করোনা ভাইরাস থেকে আমরা কেউই নিরাপদ নই। যারা নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করছেন, তারাও নিরাপদ নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইইডিসিআর থেকে সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যা বিষয়ে প্রতিদিন যে ব্রিফিং দেওয়া হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। যত বেশি টেস্ট করা হবে তত বেশি সংক্রমণের সংখ্যা আমরা জানতে পারব। সংখ্যার বিচারে আমরা যে খুব ভাল অবস্থায় আছি সেটা বলা যাবে না। আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। ’
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বেশি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ অভাব অনটনের মধ্যেই বড় হয়েছি। ছোটবেলায় আমরা বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পাইনি। সুতরাং আমারা জেনেটিক্যালি অনেকটাই দুর্বল। জন্মগতভাবেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। সুতরাং আমাদের দেশের মানুষের ফিটনেস অন্য দেশের মানুষের তুলনায় কম। এই কারণেই করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ফেরার সংখ্যাও কম। আমরা এখন যে অবস্থায় গেছি এটা খুবই কঠিন একটা সময়। মানসিক দুশ্চিন্তার কারণেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ কারণেও সুস্থ হয়ে ফেরার সংখ্যা কম হতে পারে। ’
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাক্তার নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমরা লক্ষ্য করছি আইইডিসিআরের তথ্য গোপন করার একটা বিষয়। গোপনীয়তার বিষয়টা তখনই আসে যখন নিজেদের দুর্বলতা থাকে। কিন্তু তথ্য গোপন না করে প্রকৃত তথ্য উত্থাপন করলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। সেই অবস্থা অনুযায়ী সকলেই সচেতন হতে পারে, পাশাপাশি পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণেও সহায়ক হয়। করোনা অন্য কোনো সাধারণ ভাইরাসের মতো নয়। এ ভাইরাস কাউকে এবং কোনো দেশকেই খাতির করছে না। ’
দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হওয়ার চেয়ে মারা যাওয়ার সংখ্যা বেশি প্রসঙ্গে সাবেক এ উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে। চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যেও ঘাটতি থাকতে পারে। চিকিৎসা ব্যবস্থার এই দুর্বলতা কোথায়, তা খুঁজে পূরণ করা দরকার। পর্যাপ্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তাররা করোনা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। ডাক্তারদের মধ্যে করোনা ভীতি কাজ করছে। অনেক জায়গায় ডাক্তাররা পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট পায়নি বলেও জানা যায়। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এত দুর্বল, সেটা আমরা আগে ভাবিনি। করোনায় মৃত্যুহার বেশি হওয়া চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং আমাদের জন্য হতাশাজনক। আমাদের দেশে মৃত্যুহার বেশি হওয়াতে করোনা রোগীরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন কিনা, কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে কিনা সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ’
সর্দ, জ্বর, কাশি নিয়ে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকায় মানুষ মরে যাওয়ার খবর আসছে। বেশিরবাগ ক্ষেত্রেই সেসব মৃত ব্যক্তির করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। পরীক্ষা করে পজিটিভ ফল এলেও ওই মৃত্যু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তালিকায় উঠছে না বলে অভিযোগ আছে।
রোগী শনাক্ত হওয়ার পর যেসব এলাকা লকডাউন করা হচ্ছে, সেখানে নজরদারিতেও দুর্বলতা থাকার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হলেও ক্রমাগত মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে, প্রবেশও করছে। ফলে সরকারের উদ্যোগ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
অন্যদিকে পর্যপ্ত সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করা হচ্ছে না বলে রোগী শনাক্ত হচ্ছে না এবং করোনা ভাইরাসের বাহক শনাক্ত না হলে আরও বেশি তা ছড়িয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা বিশষেজ্ঞদের।
বাংলাদেশে সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৯
আরকেআর/এজে