বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি চিকিৎসাসেবা মান। সারাদেশে বানানো হয়নি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল। চিকিৎসা, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়া হয়নি উন্নত মানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই)। কিন্তু কর্তব্যের তাড়নায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে গিয়ে নিজের অজান্তেই করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সার্বিক সমন্বয়হীনতা, আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে আছে নানা সমালোচনা। তবে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধি স্বাস্থ্যখাতকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতালে এখন কর্মরত চিকিৎসক আছেন মোট ২৫ হাজার ৬১৫ জন। চিকিৎসকসহ, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী কর্মরত রয়েছেন সর্বমোট সর্বমোট ৭৮ হাজার ৩০০ জন।
তারা বলছেন, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বেশিরভাগই সরকারি হাসপাতালে পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের সহকর্মীরা।
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) ও সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী দেশে এই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১২৮ জন চিকিৎসক ও ৭১ জন নার্সসহ মোট ১৯৯ জন। আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছে এমন ছয় শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী হোম কোয়ায়েন্টিনে আছেন। অর্থাৎ চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী (মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, কম্পিউটার অপারেটর, এলএমএসএস, আয়া, ওয়ার্ডবয়, মালি, সুইপার ও নিরাপত্তাকর্মী) মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশের ওপরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) বলছে, সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে ৬০ জনের অধিক চিকিৎসক। রাজধানীর মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১২ জন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ৫ জন, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল একজন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্তের হয়েছেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জে ১৬ জন, ময়মনসিংহে সাতজন, গাজীপুরের কালিগঞ্জে ছয়জন আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। বাকিরা দেশের অন্যান্য জেলায় আক্রান্ত। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
অন্যদিকে সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটস সংগঠনের মহাসচিব সাব্বির মাহমুদ তিহান বাংলানিউজকে বলেন, দেশের সরকারি হাসপাতালে ১৫ ও বেসরকারি হাসপাতালে ১০ ও ক্লিনিকে ৭১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এসব নার্স আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ হলো পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি ও অনেক রোগী তথ্য গোপন করে সেবা নেওয়ায় সংক্রমণের হার বেশি হচ্ছে।
বিডিএফের প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরূপম দাশ বাংলানিউজকে বলেন, যে হারে চিকিৎসকরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এতে স্বাস্থ্যখাত ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) চাইলে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সঠিক হিসাব রাখতে পারে। অথবা আমাদের এই কাজে সাহায্য করলে আমার প্রকৃত তথ্য জানতে পারতাম। কিন্তু তারা সেই কাজটি করছে না।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চিকিৎসক কিংবা নার্সিংই নন বরং স্বাস্থ্যখাতে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীরাও প্রতিনিয়ত করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এ সংখ্যা চিকিৎসা ও নার্সদের চেয়ে বেশি। যে হারে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, ফলে স্বাস্থ্যখাত ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি এটি স্বাস্থ্যখাতে জন্য অশনি সংকেত বলেও জানান তারা।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বাংলানিউজকে বলেন, সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যখাত যারা দেখভাল করছেন তাদের মধ্যে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও হাসপাতালগুলোতে সমন্বয়হীনতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে আমলারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি।
তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি-বেসরকারিভাবে যেসব পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে সেগুলো গুণগত মানের নয়। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা চক্করে পড়ে পিপিইর গুণগত মান ঠিক রাখতে পাচ্ছে না সরকারের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সময়ে চিকিৎসক, নার্স, সব স্টাফ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। এর কারণে রোগীরাও সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না।
ডা. আয়শা আক্তার বলেন, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের গুণগত মান সম্পন্ন পিপিই দেওয়া হচ্ছে। পিপিই ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসারে আক্রান্ত রোগীদের কিভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে সেই বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২০
পিএস/এএটি