বাংলাদেশে নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত শনাক্ত ব্যক্তির সংখ্যা লাখের কাছাকাছি চলে গেছে। চীনকে পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এই সংখ্যা বাড়ছে।
ইতোমধ্যে একজন প্রভাশালী রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান মন্ত্রিসভার একজন সদস্যও (প্রতিমন্ত্রী) করোনায় মারা গেছেন। এছাড়া করোনা আক্রান্ত হয়ে সিটি করপোরেশেনর একজন সাবেক মেয়র, সরকারি দলের একজন সাবেক এমপিও মারা গেছেন।
অন্যদিকে সরকারের দুই মন্ত্রী করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। কয়েকজন এমপি আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও আক্রান্ত হয়েছেন।
এদিকে বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে নতুন সংক্রমণ বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর পর্যায়ে উঠে আসছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ এখন দশম স্থানে অবস্থান করছে। আর আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে ১৮ এবং মৃত্যুর দিক থেকে ৩১তম অবস্থানে। এই অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হট স্পট হয়ে উঠেছে। জনসাধারণের একটি বড় অংশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পরও তারা উদাসীন। আবার সরকারও সাধারণ ছুটি ও লকডাউন পরিস্থিতি তুলে দিয়েছে। যার ফলে সংক্রমণের গতি বেড়েই চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ জানান, বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাক্কার চূড়ান্ত পর্যায়ের কাছাকাছি রয়েছে। এর পর দ্বিতীয় ধাক্কা আসার আশঙ্কা রয়েছে। আবার কারো কারো মতে, করোনা সংক্রমণ বর্তমানে মাঝারি পর্যায়ে রয়েছে। এখনই ঊর্ধ্বগতি টেনে ধরতে না পারলে এটা রকেটের গতিতে বাড়বে এবং পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে কঠোর লকডাউনের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। শুধু লকডাউনই নয়, তা বাস্তবায়নে তারা সরকারের কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা বলছেন। পাশাপাশি করোনা হট স্পটগুলোকে এখনই কঠোভাবে ঘিরে ফেলে ব্যাপকহারে টেস্ট এবং চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও আক্রান্তদের আলাদা করে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, নিয়ম মানছে না, নিয়ম মেনে সচেতনভাবে চলছে না। সরকার লকডাউন উঠিয়ে দিয়েছে। জনগণ উদাসীনভাবে চলছে। এ কারণেই সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার এখন জোনভিত্তিক লকডাউনের চিন্তা করছে। এটা করলে ৫/৭ দিনের মধ্যে একটা ফলাফল পাওয়া যাবে। তবে এটা যদি ফলপ্রসু না হয়, তবে পুরোপুরিভাবে কঠোর লকডউন দিতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। এখানে জনগণেরও বড় দায়িত্ব রয়েছে। সরকার একা পারবে না। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। এগুলো করতে না পারলে সংক্রমণ খুব বেশি হবে। ’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এমএইচ চৌধুরী লেলিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশ করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাক্কার চূড়ান্ত পর্যায়ের কাছাকাছি চলে গেছে। আমাদের যে পরিমাণ টেস্ট হচ্ছে তা দেশের জনসংখ্যার তুলনায় কম। যে সংখ্যা আমরা পাচ্ছি সংক্রমণ তার চেয়ে অনেক বেশি। এর পর দ্বিতীয় ধাক্কার আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সংক্রমণ এবং প্রাণহানি আরও বাড়বে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয় তো কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছেন। তারা জোনভিত্তিক লকডাউনে যেতে চাচ্ছেন। এটা পুরোপুরি সমাধান না। করোনা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। এখন শুধু পুরোপুরি লকডাউন দিলেও হবে না। হট স্পটগুলোকে কঠোরভাবে ঘিরে ফেলে পরীক্ষা বাড়াতে হবে এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হবে। সব কিছু কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ প্রথমে যে কথা বলা হয়, বাস্তবায়নের সময় তা শিথিল হয়ে যায়। এটা করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। ’
আইইডিসিআরের প্রাক্তন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুস্তাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুধু লকডাউন দিলেই যে করোনা শেষ হয়ে যাবে সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। এর জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে, সামাজিক ও সরকারি পর্যায়ে কঠোরভাবে নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেখানে কঠোর লকডাউন দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। রেড জোন, ইয়েলো জোনগুলোতে ব্যাপক হারে পরীক্ষা করে আক্রান্তদের শনাক্ত করে আলাদা করে ফেলতে হবে। আক্রান্তদের সঙ্গে গ্রিন জোনের সম্পৃক্ততা যাতে না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে এখন করোনা সংক্রমণ মাঝারি পর্যায়ে রয়েছে। এটা রকেটের গতিতে বেড়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি আমরা দেখেছি। রকেটের গতিতে যাতে না বাড়ে সেই ব্যবস্থা আগে থেকেই নিতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪২ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২০
এসকে/এজে