যশোর: যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির অবহেলায় বরাদ্দের প্রায় ১০ কোটি টাকা ফেরত চলে গেছে।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে এমএসআর ও ইডিসিএল থেকে মানুষের চিকিৎসাসেবায় এ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
যার কারণে চলতি বছর চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে দারুণভাবে সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হবে যশোর জেলাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা-উপজেলার অন্তত ২০ লাখ মানুষ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, যশোরসহ আশপাশের কয়েকটি জেলা ও উপজেলার রোগীদের আশা ভরসার স্থল হলো যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল। সরকারি এ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে দ্বিগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকে সব সময়।
বহির্বিভাগে গড়ে চিকিৎসা সেবা নেন ৯শ’ থেকে হাজার রোগী। স্বনামধন্য হাসপাতাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় যশোর ছাড়াও নড়াইল, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মাগুরা জেলার অধিকাংশ মানুষ এখানে আসে চিকিৎসা নিতে। উদ্দেশ্য একটাই, অল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়া।
এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) হলো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। মোট বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ তারা সরবরাহ করে থাকে। বাকি ২৫ শতাংশ কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারেরা সরবরাহ করেন। সেই লক্ষ্যে যশোরের মানুষের চিকিৎসা সেবায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরের এমএসআর (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিকুইজিট) দ্রব্যাদ্রি, ওষুধপত্র, গজ, ব্যান্ডেজ, লিলেন সামগ্রী যন্ত্রপাতি, কেমিক্যাল আসবাবপত্র খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি বছর ১৫ এপ্রিল প্রথম টেন্ডার আহ্বান করে ঠিকাদাররা টেন্ডার ড্রপ করার পরেও করোনাসহ নানা অজুহাতে বাতিল করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে গত মে আবার দ্বিতীয়বারের মতো টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সেখানে বরাদ্দকৃত ৭ লাখ টাকার মতো খরচ করা হয়েছে তড়িঘড়ি। এসব টাকা ছিল যশোরের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য। কিন্তু দক্ষতার অভাবে মোটা অংকের টাকা যশোরবাসীর স্বার্থে কাজে লাগাতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাকি টাকা জুনের শেষে ফেরত গেছে সরকারি কোষাগারে।
একই অবস্থা হয়েছে সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলের ক্ষেত্রে। ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ করতে না পারায় সরকারি কোষাগারে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বরাদ্দকৃত ১ কোটি ২২ লাখ টাকা ফেরত গেছে। এমএসআর ও ইডিসিএলসহ এ খাত থেকে ফেরত গেল ১০ কোটি টাকার বেশি। অথচ যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে সারা বছর ওষুধের ব্যাপক সংকট থাকে। যে সংকট এখন মারাত্মক রূপ নিয়েছে। গ্যাসের ব্যথা ও কিছু অ্যান্টিবায়েটিক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ক্যালসিয়াম ও জ্বরের ওষুধ ছাড়া মূল্যবান ওষুধ পায় না রোগীরা। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে রোগীদের গ্যাসের ওষুধসহ নিম্নমানের কিছু ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি মূল্যবান ওষুধ বাইরে থেকে কেনার জন্য লিখে দেওয়া হয় রোগীর ব্যবস্থাপত্রে। হাসপাতালের বরাদ্দকৃত এমএসআর দ্রব্যাদি ও ইডিসিএলের ওষুধের সরবাহর করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হওয়ার এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে হাসপাতালে গেলে রোগীরা অভিযোগ করেন, অস্ত্রোপচারের কাজে ব্যবহৃত গজ, ব্যান্ডেজ, ওষুধ ও হ্যান্ড গ্লাভসও রোগীদের কিনে আনতে হচ্ছে। চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে এ হাসপাতালে ৮৪ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ইডিসিএল ৪৪ প্রকার ও স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্থানীয় অর্থে টেন্ডারের মাধ্যমে অবশিষ্ট ৪০ প্রকার ওষুধ কর্তৃপক্ষ কেনে। বর্তমানে হাসপাতালে গুরুত্বপূর্ণ দামি কোনো ইনজেকশন, ওষুধ ও গজ ব্যান্ডেজ পর্যপ্ত নেই।
হাসপাতালের সার্জারি, মেডিসিন, হৃদরোগ, গাইনি, অর্থোপেডিকস, শিশু, পেয়িং, লেবার ওয়ার্ডের একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে যৎসামান্য ওষুধ দেওয়া হয়। অধিকাংশ ওষুধ ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাইরে থেকে কিনে আনতে হয় তাদের। এদিকে ভর্তি হওয়া রোগীদের বাসা থেকে বালিশ, বালিশের কাভার, মশারি এনে বেডে থাকতে হয়। এতো সংকট ও নানান অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির অবহেলায় বরাদ্দের টাকা ফেরত যাওয়ায় চলতি বছরে সংকট আরো বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে ২ হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। তার মধ্যে জরুরি সেবা অর্থাৎ হাত-পা ভাঙা, দুর্ঘটনা ও মারামারিতে আহত রোগী বেশি। এসব জরুরি রোগীর সেবার জন্য দরকার হয় গজ-ব্যান্ডেজসহ নানা সরঞ্জাম; কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থ বছরের এসব সরঞ্জাম কেনার টাকা ফেরত যাওয়ায় কষ্ট হবে জরুরি বিভাগের রোগীদের। আগে যেখানে এসব সরঞ্জাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে দিত, এখন তা রোগীদের বাইরে থেকে বেশি দামে কিনে আনতে হবে।
হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মণিরামপুর উপজেলার সালামুতপুর এলাকার গৃহবধূ সালমা আক্তার বলেন, দুইদিন আগে আমার সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছে। এর জন্য আমাদের তিন হাজার টাকার সরঞ্জাম ও ওষুধ কিনতে হয়েছে। শুনি সরকারি হাসপাতাল ওষুধ দেয়, এবার বুঝলাম কেমন ওষুধ দেয়।
সার্জারি ওয়ার্ডের ভর্তি রয়েছে জহিরুল ইসলামের ছেলে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার ছেলে সাকিবুলের (১২) হাত ভেঙেছে। অস্ত্রোপচারের জন্য ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হাসপাতাল থেকে কিছুই সরবরাহ করা হয়নি।
এ বিষয়ে হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট জহিরুল ইসলাম বলেন, বহির্বিভাগে ওষুধের কোনো সংকট নেই। আর ভর্তি রোগীদের সারা বছরই কোনো কোনো ওষুধ সাপ্লাই বন্ধ থাকে। এ কারণে এসব ওষুধ কিনতে হয় রোগীদের।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক কর্মকর্তা ডা. আরিফ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বহির্বিভাগের রোগীদের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। তবে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীদের সব ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না। যা আছে সেই ওষুধগুলোই দেওয়া হচ্ছে।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলীপ কুমার রায় বাংলানিউজকে বলেন, ইডিসিএল ওষুধের টাকা ফেরত গেছে সরকারি সিস্টেমের কারণে। সরবরাহ দিতে পারেনি, তাই। এমএসআর বাবদ টাকা ফেরত গেছে, কারণ, ঠিকাদার দিতে পারেনি। শেষ সময়ে টেন্ডার হওয়ার কারণে এ সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় অর্থ বছরের শেষে নিয়ম অনুযায়ী টাকা ফেরত দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২০
ইউজি/এসআই