ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

গ্রামে ছড়াচ্ছে করোনা, ভাঙছে বিভ্রান্তির দেয়াল

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩২ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২১
গ্রামে ছড়াচ্ছে করোনা, ভাঙছে বিভ্রান্তির দেয়াল হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে রোগ। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে একটাই কথা ছিল যে, ‘আমাদের গ্রামে করোনা নেই; আমাদের করোনা ভাইরাস হবে না’। এজন্য তারা মুখে মাস্ক পরা বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করতেন না।

কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে করোনার প্রকোপ এখন বিভাগীয় শহর রাজশাহীর পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রতিদিনই গ্রাম থেকে আসা করোনা রোগীর চাপ বাড়ছে। হালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) ভর্তি করোনায় আক্রান্ত রোগীর ৪০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। আর করোনায় মৃতদের মধ্যে অধিকাংশাই ভারতের ডেল্টা ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত ছিলেন, বলছেন চিকিৎসকরা।

রাজশাহীতে চলমান সর্বাত্মক লকডাউনের মধ্যেও গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে ৫ জনের রিপোর্ট পজিটিভ এবং বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মঙ্গলবার (১৫ জুন) সকাল ৬টা থেকে বুধবার (১৬) সকাল ৬টার মধ্যে বিভিন্ন সময় তারা মারা যান। মৃতদের মধ্যে রাজশাহীর আটজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারজন ও কুষ্টিয়ার একজন রয়েছেন। এ নিয়ে চলতি মাসের এই ১৬ দিনে (১ জুন সকাল ৬টা থেকে ১৬ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত) রামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ১৬১ জনের মৃত্যু হলো।

পরবর্তী পরিস্থিতিতে রামেক হাসপাতালের সূত্রগুলো বলছে, করোনা এখন শুধু শহরেই নয়, বিস্তার ঘটিয়েছে গ্রামাঞ্চলেও। তাই হাসপাতালে প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের হার, বাড়ছে রোগী ভর্তির সংখ্যাও। গেল ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ৪৮ জন। যাদের বেশিরভাগের বাড়ি রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায়।

বর্তমানে বয়স্ক মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তরুণদের মৃত্যুর হারও। রোগীর চাপ সামলাতে হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটসহ মোট ১৩টি ওয়ার্ডে চলছে করোনা রোগীর চিকিৎসা। প্রস্তুত করা হচ্ছে আরও একটি ওয়ার্ড।
আর বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৪৪ জন। অথচ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে শয্যা সংখ্যা ছিল ২৭১টি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে বেড সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০৯টি করা হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্ত রোগীর অবস্থা বেশিমাত্রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম থাকছে। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হঠাৎ করে বাড়ছে। শারীরিক অবস্থার নানান ধরনগুলো দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করার সময়ও দিচ্ছে না এই ধরনগুলো। শহরে যেমনভাবে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে গ্রামে তা হচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চল থেকে এখন বেশি রোগী আসছে। একজন করোনা রোগী সারা গ্রাম মাস্ক ছাড়াই ঘুরছেন। এভাবে অনেক মানুষ আক্রন্ত হচ্ছেন।

এই পরিস্থিতিতে করোনার ঢেউ ঠেকাতে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও বিধিনিষেধ আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া সর্বাত্মক লকডাউনের সুফল পেতে সাত দিন নয়, অন্তত ১৪ দিন দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বুধবার বিধিনিষেদের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের জরুরি বৈঠক বসার কথা রয়েছে। রাতে রাজশাহী সার্কিট হাউজ থেকে লকডাউনের নতুন সিদ্ধান্তও আসতে পারে।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. পার্থ মণি ভট্টাচার্য বলেন, এবার রোগী ভর্তির পর থেকেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লিভার, কিডনি ও ডায়বেটিক রোগীদের সমস্যা আরও বেশি।

সার্বিক বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, করোনায় আক্রান্তদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায়, মৃত্যুর হারও কমছে না। গতবারের তুলনায় এবার করোনার ধরন অনেকটাই আলাদা। এখন হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে ৪০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের। গ্রামের মানুষ বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি না মানা, মাস্ক না পড়া ও অবাধে সব জায়গায় চলাফেরার ফলে এই সংক্রমণের হার বেড়েছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীরা অনেক দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। আক্রান্ত হওয়ার একপর্যায়ে যখন দেখতে পাচ্ছেন-আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না তখন হাসপাতালে আসছেন। রোগীরা দেরি করে ফেলায় মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। বর্তমানে করোনা রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে চিকিৎসা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তখন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন রামেক হাসপাতালের পরিচালক।

হাসপাতাল পরিচালক আরও বলেন, ঈদে চরমভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হয়েছে। তাই ঈদের পর করোনার সংক্রমণও হঠাৎ করে বেড়েছে। তবে শুধু স্বাস্থ্যবিধি মানলে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট নয়; অন্য ভেরিয়েন্টও কমিয়ে আনা সম্ভব। কয়েকদিন কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ফলে গতকাল শনাক্তের হার কিছুটা কমেছে। স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মানা হলে শনাক্তের হার আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০২১
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।