বাগেরহাট: বাগেরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কটে দুর্ভোগ বাড়ছে রোগীদের। দীর্ঘদিন ধরে ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটি চলছে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে।
এদিকে সার্জারি, গাইনি, চক্ষুসহ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসার জন্য রোগীদের যেতে হয় খুলনাসহ বড় শহরে। সেই সঙ্গে চিকিৎসকদের অবহেলা, শয্যা সঙ্কট ও অবকাঠামো নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে রোগী ও স্বজনদের। এ অবস্থায় দ্রুত প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন চিকিৎসক সঙ্কট মেটাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৮ লক্ষাধিক মানুষের প্রধান চিকিৎসালয় বাগেরহাট সদর হাসপাতাল। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের জেলে, বাওয়ালী ও বনজীবীরাও চিকিৎসা নিতে আসেন এই হাসপাতালে। ১৯৭০ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জ এলাকায় এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। ২৭ বছর পরে ১৯৯৭ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটিকে। তবে ১শ’ শয্যায় উন্নীত হলেও ২৪ বছর ধরে ৫০ শয্যার জনবল নিয়েই চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। বর্তমানে ৫০ শয্যার জনবলও অর্ধেকে নেমে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালে কনসালট্যান্টের ১২টি পদের মধ্যে ৭টি এবং মেডিক্যাল অফিসারের ১২টি পদের ১০টি পদই শূন্য রয়েছে। কনসালটেন্টের শূন্য পদের মধ্যে রয়েছে সিনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি, গাইনি, চক্ষু, অ্যানেস্থাসিয়া, জুনিয়র কনসালটেন্ট অর্থোট্রমেটিক, কার্ডিওলজি, রেডিওলজি। আর মেডিক্যাল অফিসারদের মধ্যে ডেন্টাল সার্জন, ইউনানী মেডিক্যাল অফিসার, মেডিক্যাল অফিসার, প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্টের পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া একজন নার্সিং সুপারভাইজার, একজন হেলথ এডুকেটর, ২০ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, ২ জন কার্ডিওগ্রাফার, ৪ জন সহকারি নার্স এবং একজন অফিস সহায়কের পদও শূন্য রয়েছে। কাঙ্খিত চিকিৎসক না থাকায় প্রতিদিনিই দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের ফিরে যেতে দেখা যায়। সঙ্কট পূরণে আরও বেশি উদ্যোগী হওয়ার দাবি রোগী ও রোগীর স্বজনদের।
রামপাল উপজেলার মল্লিকেরবেড় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মোসা. লাকি আক্তার বলেন, বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ গরীব মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন। কিন্তু এখানে আসলে এই ডাক্তার নেই, ওই ডাক্তার নেই, শুধু নেই আর নেই। রামপালের মত প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে আসার পরে তাকে বিনা চিকিৎসায় খুলনা বা অন্য কোথাও যেতে হয়, এর মত বিড়ম্বনা আর কিছুই নেই। অতি দ্রুত এই হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
নুসরাত জাহান নামের এক নারী বলেন, কিডনির সমস্যায় শ্বশুরকে নিয়ে এসেছিলাম হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তাররা বললেন এখানে কোন চিকিৎসা হবে না, খুলনা নিয়ে যান। তাই চলে যাচ্ছি।
চিকিৎসাধীন মো. দেলোয়ার হোসেন নামের এক রোগী বলেন, অনেক রোগীর জন্য তিন কক্ষ বিশিষ্ট একটি টয়েলেট। তার মধ্যে একটি নষ্ট। দুটি টয়েলেট পয়:নিস্কাসনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। অনেক সময় লাইন লেগে যায়। কখনও কখনও টয়েলেটের সামনে কাপড়েও কেউ কেউ মলত্যাগ করে ফেলেন। জরুরি ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন।
পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি নুর আহমেদ নামের এক রোগী বলেন, টাইফয়েড নিয়ে কয়েকদিন ধরে ভর্তি রয়েছি। প্রতিদিন একজন চিকিৎসক দেখেন। কোন পরিবর্তন হয় না। মনে হয়, আমার এই রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই এখানে।
মো. মিজান হাওলাদার নামের এক রোগী বলেন, কোন রোগী দুপুর ১২টায় ভর্তি হলে, তাকে পরের দিন সকালে একজন চিকিৎসক দেখেন। এই সময়ে রোগী কষ্টে মরে গেলেও নার্স ছাড়া কোন চিকিৎসক পাওয়া যায় না। একদিন পরে রোগী দেখার এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারলে সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।
মুন্নি, সুমনা আক্তার, দোলোয়ার হোসেনসহ স্থানীয় কয়েকজন বলেন, ডাক্তার না থাকার কারণে প্রতিদিনই অনেক রোগীকে এই হাসপাতাল থেকে খুলনাসহ বিভিন্ন বড় শহরে যেতে দেখা যায়। মঞ্জুরীকৃত পদ অনুযায়ী এই হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগ দিলে মানুষের আর খুলনা যেতে হবে না বলে দাবি করেন তারা।
বাগেরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার শেখ আদদান হোসেন বলেন, এখানে অনেকদিন ধরেই চিকিৎসক সঙ্কট রয়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে কিছুটা বঞ্চিত। এরপরও আমাদের যে জনবল রয়েছে, তাই দিয়েই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার।
জেলা সিভিল সার্জন ড. জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাগেরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। ৪২তম বিএসএসের নিয়োগ সম্পন্ন হয়ে গেলে আশা করি এই সঙ্কটের অনেকটাই সমাধান হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৮ ঘণ্টা, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২
এমএমজেড