কথায় আছে, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর ভাল থাকলে মন যেমন ভাল থাকে তেমনি কাজেও উদ্যম পাওয়া যায়।
১. কোলন কি ?
কোলনকে আমরা লারজ ইনটেসটাইন বা ব্রহদান্ত বলি। কোলনের সিকাম নামক প্রথম অংশটি উদর বা এবডমিনের ঠিক নিচের ডান পাশের এবং এটা ক্ষুদ্রান্ত্রের শেষ প্রান্তে ইলিয়াম নামক অংশটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। সিকাম ছাড়া কোলনের অন্য অংশকে ঠিক চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে : ১. এসেনডিং কোলন যা সিকামের ঠিক উপরের দিকে এবং উদরের ডানপার্শে অবস্থিত, ২. ডিসেনডিং কোলন উদরের বামপার্শে নিচের দিকে প্রবাহিত, ৩. ট্রান্সভারস কোলন উদরের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ৪. রেক্টাম বা মলনালির ঠিক আগে ছোট ও বেঁকে যাওয়া কোলনের চতুর্থ অংশটিকে বলা হয় সিগময়েড কোলন। কোলন দেখতে অনেকটা টিউব আকৃতির মতো। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের কোলন প্রায় চার থেকে ছয় ফুট লম্বা হয় এবং এর গড় ডায়ামিটার বা ব্যাস প্রায় আড়াই ইঞ্চির মতো।
কোলন হয়ে রেক্টামের মাধ্যমে শরীর থেকে মল নিষ্কাশিত হয়। এই প্রক্রিয়ার আগে শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপাদান যেমন নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিন, লবণ, পুষ্টিকর পদার্থ এবং পানি কোলন শুষে নেয়। কোলন শরীরের মধ্যে প্রবাহমান তরল পদার্থের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
২. কোলন বা কোলোরেকটাল ক্যান্সার
কোলন ক্যান্সারটি শুরু হয় ব্রহদান্তে বা কোলনের উপরে বর্ণিত চারটি অংশের যেকোনো জায়গায় অথবা কোলনের শেষ প্রান্তে অবস্থিত রেক্টামে বা মলনালিতে। কোলন ক্যান্সারকে রেকটাল ক্যান্সারও বলা হয়ে থাকে যদি কি না ক্যান্সারটির উৎপত্তির স্থান মলনালিতে হয়। কোলন এবং রেকটাল দুটো ক্যান্সারেরই লক্ষণ বা উপসর্গগুলো প্রায় কাছাকাছি।
নানাবিধ কারণে শরীরের মধ্যে কোলন ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে। এই ক্যান্সারটি শরীরের মধ্যে বসতি স্থাপনের জন্য ধীরে ধীরে অনেক সময় নিয়ে নেয়। এমনকি কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। ক্যান্সার স্থায়ীভাবে বাসা বাধার অনেক আগে থেকেই কোলনের বা রেক্টামের সবচেয়ে ভিতরের লেয়ার বা আস্তরণে নন- ক্যান্সারাস (বিনাইন) পলিপ সৃষ্টি হতে থাকে। এই পলিপগুলো ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। তবে সব ধরনের পলিপই যে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় তা নয়। কোন কোন ধরনের পলিপগুলো ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী তা পরীক্ষার মাধ্যমে পলিপের প্রকারভেদ জেনে খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়। যেমন, এডেনোম্যাটাস পলিপগুলো (এডেনোমাস) প্রি- ক্যান্সারাস এবং এগুলো ধীরে ধীরে অনেক সময়ের ব্যবধানে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। আর এক ধরনের পলিপ আছে যার নাম হাইপারপ্লাসটিক এবং ইনফ্লামেটরি পলিপ্স যেগুলো সাধারণত প্রি- ক্যান্সারাস নয়। কিন্তু এখন ডাক্তাররা মনে করেন যে, হাইপারপ্লাসটিক পলিপ গুলোও প্রি- ক্যান্সারাসে পরিণত হতে পারে অথবা কোলনের এসেনডিং অংশের মধ্যে এডেনোমাস এবং ক্যান্সার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন ধরে আলসারের ক্ষতের কারনে মলাশয়ে প্রদাহ (আলসারেটিভ কোলাইটিস) এবং ক্রন’স রোগে আক্রান্ত থাকেন, তাঁদের কোলনে ডিসপ্লেসিয়া নামক এক ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে মাইক্রোস্কোপের নিচে সেলগুলোর আকৃতি দেখতে মনে হয় অস্বাভাবিক ধরনের কিন্তু সেগুলো সত্যিকার অর্থে ক্যান্সার সেল নয়, তবে সময়ের ব্যবধানে এগুলো ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়।
আমেরিকাতে ক্যান্সার ঘটিত কারণে যত মানুষ মারা যায়- তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় লাং বা ফুসফুসের ক্যান্সারে এবং তার পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত হয় কোলন ক্যান্সারের কারণে (নারী এবং পুরুষ সম্মিলিতভাবে)। এখানে প্রতি ৯.৩ মিনিটে একজন বা বছরে প্রায় পঞ্চান্ন হাজার লোক কোলোরেকটাল ক্যান্সারে মারা যায়।
৩. কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকিসমূহ
যে যে কারণগুলো কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, সেগুলো যেমন :
• পুরুষ বা স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে কোলোরেকটাল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সমান থাকে। তবে দেখা যায় যে, স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে কোলন আর পুরুষের ক্ষেত্রে রেক্টাল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিই বেশি থাকে।
• আপনার বয়স যদি পঞ্চাশ বা তার অধিক হয়।
• আপনি যদি রেড (লাল) মিট (গরু, খাসি ও মহিষের মাংস, মেষ বা ভেড়ার মাংস, কলিজা ইত্যাদি) বা প্রছেস মিট খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রছেস মিট বলতে বোঝায় যেমন- বীফ জারকি, সসেজ, হট ডগ, সেন্ডউইচের ভিতরের মাংস, মাংসযুক্ত ফ্রজেন পিজা, মাংসযুক্ত ফ্রজেন খাদ্য বা ক্যানে থাকে এমন মাংসযুক্ত খাবার, জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টের সেন্ডউইচের মধ্যে যে মাংস ব্যবহার করা হয়, বাচ্চাদের জন্য রেডমিট যুক্ত খাবারগুলো ইত্যাদি।
• খুব বেশি চর্বি ও ক্যালরিযুক্ত এবং কম আঁশযুক্ত (লো ফাইবার) খাবারের অভ্যাস থাকলে
• আপনার শরীরের অন্য কোথাও যদি আগে থেকেই অন্য ক্যান্সার থেকে থাকে
• যদি কোলোরেকটাল পলিপ্স (এডেনোমাস) থেকে থাকে
• ক্রনস রোগ বা আলসারেটিভ কলাইটিস আগে থেকেই থেকে থাকে
• যদি পরিবারের কারো (পিতামাতা, ভাইবোন বা ছেলেমেয়ে) আগেই কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড থেকে থাকে
• মেয়েদের ক্ষেত্রে যদি ব্রেসট, ইউটেরিন বা ওভারিয়ান ক্যান্সার হওয়ার পূর্ব রেকর্ড থেকে থাকে
• ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৪০% বেশি ঝুঁকি থাকে
• খুব বেশি এলকোহল সেবন, অত্যধিক ধূমপান করা, ব্যায়াম না করা ও অত্যধিক ওজন বাড়ানো- শরীরের মধ্যে কোলোরেকটাল ক্যান্সার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এ ছাড়াও কিছু কিছু জিন ডিফেকট বা মিউটেসনের কারণে কোলোরেকটাল ক্যান্সার হতে পারে। নিম্নের মিউটেটেড জিনগুলোর সঙ্গে কোলোন ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। মিউটেটেড জিনগুলো হলো- যেমন, এফ. এ. পি. বা ফেমিলিয়াল এডেনোমাটাস পলিপোসিস, এইচ. এন. পি. সি. সি. বা হেরিডিটেরি নন-পলিপোসিস কোলোরেকটাল ক্যান্সার (এটিকে লিনস সিনড্রমও বলা হয়ে থাকে), টারকট সিনড্রম (মেডিউলোব্লাসটোমাস, গ্লিওব্লাসটোমাস) ( এই ডিফেকটের কারনে সাধারনতঃ ব্রেইন টিউমারের সৃষ্টি হয়) এবং MUTYH জিন পলিপোসিস। এছাড়াও ইস্টার্ন ইউরোপের জিউস বা ইহুদীদের (আসকেনাজি জিউস) শরীরে একটি নির্দিষ্ট ধরনের জেনেটিক মিউটেসনের হার অন্য যেকোনো এথনেসিটির চেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। তাদের শরীরে ডিএনএ পরিবর্তনের ফলে যে জেনেটিক মিউটেসনের সৃষ্টি হয় তার নাম হচ্ছে আই-১৩০৭কে এপিসি মিউটেসন। এই মিউটেসনের কারণে শরীরে কোলোরেকটাল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে , যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী শতকরা ছয় ভাগ জিউসদের শরীরে এই নির্দিষ্ট জেনেটিক মিউটেসনটি (আই-১৩০৭কে এপিসি) বিদ্যমান যা কোলোরেকটাল ক্যান্সারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আফ্রিকান আমেরিকানদের শরীরে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি, যদিও এর প্রকৃত কারণ এখনো অজানা রয়েছে।
৪. কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ বা উপসর্গগুলো
কোলন ক্যান্সার সাধারণত অনেক দেরিতে ধরা পড়ে। কোলন ক্যান্সার হলে একপর্যায়ে শরীরের মধ্যে কতকগুলো লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। অধিকাংশ কোলন ক্যান্সারের রোগীর ক্ষেত্রেই নীচের এক বা একাধিক লক্ষণ প্রকাশ পায় :
• উদর বা এবডমেনের মধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করা।
• পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসা বা পায়খানার রং খুব বেশি বেশি কালো অনুভূত হওয়া (ব্লাডি স্টুল)।
• শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত অনুভূত হওয়া, এনেমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেওয়া ।
• ডাইরিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য বা অন্ত্রের মধ্যে অন্য বিশেষ ধরনের কোনো পরিবর্তন অনুভূত হওয়া এবং এ অবস্থা দু’ সপ্তাহ বা তার অধিক সময় ধরে চলতে থাকা।
• পেন্সিলের মতো চিকন হয়ে পায়খানা নির্গত হওয়া এবং এই অবস্থা দু’ সপ্তাহের অধিক সময় ধরে চলতে থাকা।
• অজানা কোনো কারণে শরীরের ওজন কমতে থাকা ।
৫. কোলন ক্যান্সার সনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষাসমূহ
কোলন ক্যান্সার নিখুঁতভাবে শনাক্তের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষা রয়েছে। আপনার শরীরে কি কি ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে, ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরীক্ষাগুলো জেনে নিতে পারবেন। তবে কোলন ক্যান্সারের রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা সচরাচর যে পরীক্ষাগুলো করে থাকেন, তা হলো নিম্নরুপঃ
• ডিজিটাল রেকটাম এক্সাম (ডিআরই)
• ফিকাল ওকালট ব্লাড টেস্ট (এফওবিটি)
• সিবিসি বা কম্প্লিট ব্লাড কাউনট
• সিগ্ময়ডসকপি
• ডাবল কনট্রাস্ট বেরিয়াম এনেমা
• কোলনস্কপি
• কারসিনো ইমব্রায়নিক এন্টিজেন টেস্টিং ।
উপরের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একমাত্র কোলনস্কপির মাধ্যমেই সমস্ত কোলনের ভিতরের ছবি দেখা সম্ভব এবং এই পদ্ধতিটিই হচ্ছে কোলন ক্যান্সার শনাক্তের জন্য সবচেয়ে উত্তম স্ক্রিনিং টেস্ট।
ক্যান্সারটি যদি দেরিতে ধরা পরে এবং শরীরের অন্যান্য অর্গানে ছড়িয়ে পড়ে থাকে, তখন এই অবস্থাকে বলা হয় ষ্টেজিং। এই ক্ষেত্রে ডাক্তার আপনার শরীরের উপর আরো অতিরিক্ত কিছু পরীক্ষা অবশ্যই করবেন। পরীক্ষাগুলো নিম্নরূপঃ
• সিটি বা ক্যাট স্ক্যান
• এম আর আই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং)
• প্যাট (পজিট্রন ইমিসন টমগ্রাফি) স্ক্যান ।
৬. কোলন ক্যান্সার ছড়ানোর ধাপসমূহ (স্টেজিং)
কোলন ক্যান্সারটি কোলনের দেয়ালের কতো গভীরে বা তাঁর আশপাশে বা এর লিমফ নোডগুলোতে বা দুরের কোনো অর্গানে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা, তা জানার জন্য এটাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে :
• স্টেজ বা ধাপ শূন্য : এটাকে কোলন ক্যান্সারের সবচেয়ে প্রাথমিক পর্যায় বলা হয়। অ্যাবনরমাল বা অস্বাভাবিক সেলগুলোকে কোলনের সবচেয়ে ভিতরের আস্তরণে (মিউকসা) বা রেক্টামের দেয়ালে কেবলমাত্র দেখা যায়। এই ধাপকে ইনট্রামিউকোসাল কারসিনোমাও বলা হয়ে থাকে।
• ধাপ এক : এই অবস্থায় ক্যান্সারটি সৃষ্টি হয় ঠিক কোলনের মাংসপেশির যে পাতলা লেয়ার বা আস্তরণ (মাসকোলারিস মিউকোসা) থাকে এবং সেই মাংসপেশির আস্তরণের নীচে যে ফাইব্রাস টিস্যু (সাবমিউকোসা) থাকে সেখানে। এটা মাংসপেশির মোটা আস্তরণেও (মাসকোলারিস প্রপ্রিয়া) সৃষ্টি হতে পারে।
• ধাপ দুই : ক. এই অবস্থায় ক্যান্সারটি মাংসপেশির মোটা আস্তরণে সৃষ্টি হয় এবং তা ভেদ করে কোলনের বা রেক্টামের সবচেয়ে বাইরের আস্তরণ পর্যন্ত পৌঁছায়।
খ. এ পর্যায়ে কোলনের বা রেক্টামের দেয়ালের মধ্যে ক্যান্সারটি সৃষ্টি হয় কিন্তু আশপাশের টিস্যু বা অর্গানে এখনো ছড়ায়নি।
গ. কোলনের বা রেক্টামের দেয়ালের মধ্যে ক্যান্সারটি সৃষ্টি হয়ে ইতোমধ্যেই আশপাশের টিস্যু বা অর্গানের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে মাত্র তবে তা এখনো নিকটতম লিমফ নোডস বা দূরবর্তী অর্গানগুলোতে ছড়ায়নি।
• ধাপ তিন : ক. ক্যান্সারটিকে মিউকোসা, সাবমিউকোসা এবং মাসকোলারিস প্রপ্রিয়া পর্যন্ত দেখা যায় এবং তা ইতোমধ্যেই নিকটতম এক থেকে তিনটি (কখনো চার থেকে ছয়টি) পর্যন্ত লিমফ নোডসে ছড়িয়ে পড়ে।
খ. এই অবস্থায় ক্যান্সারটি সাত বা তার অধিক লিমফ নোডগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে তবে এখনো দূরবর্তী কোথাও ছড়িয়ে পড়েনি।
গ. এই অবস্থায় ক্যান্সারটি সাত বা তার অধিক লিমফ নোডগুলোতে ছড়িয়ে তা নিকটতম টিস্যু বা অর্গানগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে অথবা নিকটতম টিস্যু বা অর্গানগুলোতে ইতোমধ্যেই ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়েছে বুঝায় তবে এখনো দূরবর্তী কোথাও ছড়িয়ে পড়েনি।
• ধাপ চার : ক. এই অবস্থায় ক্যান্সারটি শরীরের দূরবর্তী একটি অর্গানে (যেমন- লিভার, ফুসফুস) বা একগুচ্ছ লিমফ নোডসে ছড়িয়ে পড়েছে বুঝায়।
খ. এই অবস্থায় ঘাতক ক্যান্সারটি শরীরের মধ্যে দূরবর্তী একের অধিক অর্গানে (যেমন- লিভার, ফুসফুস, পেরিটোনিয়াম, বা ওভারিস) বা একগুচ্ছ দূরের লিমফ নোডগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে বুঝায়।
৭. কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা
কোলন ক্যান্সার শনাক্তের জন্য যেমন অনেক টেকনিক রয়েছে, ঠিক এ রোগটিকে নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও রয়েছে বেশ কিছু চিকিৎসা ব্যবস্থা। উপসর্গগুলো দেখা দেবার আগেই সঠিক স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমে কোলন ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব। কোলন ক্যান্সারটি যদি প্রাথমিক পর্যায়ে (ধাপ শূন্য) ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে এটিকে শরীর থেকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব। অনকোলজিসটরা কোলন ক্যান্সারের রোগীদের ক্ষেত্রে সচরাচর যে চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে থাকেন, তা হলো নিম্নরূপ :
• সার্জারি (লোকাল এক্সিসন, রিসেক্সন, রিসেক্সন এবং কোলসটোমি, রেডিওফ্রিকুয়েন্সি অ্যাবলাসন এবং ক্রাইও সার্জারি)। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা সার্জারির আশ্রয় নেন এবং ক্যান্সারের ধাপের উপর নির্ভর করে সঠিক সার্জারি প্রয়োগ করেন।
• কেমোথেরাপি (সিস্টেমিক ও রিজিওনাল কেমোথেরাপি)।
• রেডিয়েশন থেরাপি (এক্সটারনাল এবং ইন্টারনাল রেডিয়েশন থেরাপি)।
• টার্গেটেড থেরাপি (যেমন মনোক্লনাল এনটিবডিস)
সার্জারির মধ্যমে শরীর থেকে ক্যান্সার সেলগুলোকে অপসারণ করা হয়। কেমোথেরাপির মাধ্যমে সাধারণত ক্যান্সার সেলগুলোকে মেরে ফেলা বা উৎপন্ন থেকে বিরত রাখা হয়। আর রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সারাস টিস্যুগুলোকে ধ্বংস করা হয়।
প্রাথমিক বা ধাপ শূন্য কোলন ক্যান্সার অপসারণের ক্ষেত্রে শুধু সার্জারিই যথেষ্ট, এক্ষেত্রে কেমো বা রেডিয়েশন থেরাপির প্রয়োজন পড়ে না। অনকোলজিসটরা অনেক সময় সার্জারি না করে কোলনস্কপি চলাকালীন সময়েও স্টেজ শূন্য ক্যান্সার সেলগুলোকে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হন। তবে স্টেজ এক, দুই ও তিন টাইপের কোলন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ব্যাপক সার্জারির প্রয়োজন হয় এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত কোলনের অংশটুকুকে সম্পূর্ণভাবে কেটে বাদ দেওয়া হয়। অপারেশনের পরে কেমোথেরাপিরও প্রয়োজন দেখা দেয়। যেমন- সার্জারির পরেও অনকোলজিসটরা ধাপ দুই টাইপের রোগীদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি নিতে বলেন। যদিও এই বিষয়ে এখনো অনেক ডিবেট রয়েছে যে ধাপ দুইয়ের রোগীদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির প্রয়োজন আছে কিনা।
তবে যারা কোলন ক্যান্সারের ধাপ তিনের রোগী, তাদের অধিকাংশই সার্জারির পরেও কমপক্ষে ছয় থেকে আট মাস কেমোথেরাপি গ্রহণ করেন এবং ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকেন। আর যারা রেকটাল ক্যান্সারের ধাপ তিনের রোগী, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত কেমোথেরাপির পাশাপাশি রেডিয়েশন থেরাপিও দেওয়া হয়ে থাকে। আর যারা ধাপ চারের রোগী এবং ক্যান্সারটি লিভারে বা দূরের অন্য কোনো অর্গানে ছড়িয়ে পড়েছে, সেক্ষেত্রে কেমো বা টার্গেটেড বা রেডিয়েশন থেরাপির বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্যান্সারে আক্রান্ত সেল বা টিস্যুগুলিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়।
আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কোলন এবং রেকটাল ক্যান্সারের জন্য বেশ কিছু ড্রাগ অনুমোদন করেছে । এই ড্রাগগুলো বিভিন্ন ধাপের রোগীর উপরে সচরাচর প্রয়োগ করা হয়। এফডিএ দ্বারা অনুমোদিত ড্রাগগুলো হলো : এড্রসিল (ফ্লোরইউরেসিল), বিভাসিজুমেব (এভাসটিন), কেম্পটোসার (ইরিনোটেকান হাইড্রোক্লোরাইড), ক্সেলোডা (কেপসিটাবাইন), সেটুক্সিমেব (ইরবিটাক্স), ইফিউডেক্স (ফ্লোরইউরেসিল), ইলোক্সাটিন (অকজালিপ্লাতিন), পানিটুমিউমেব (ভেকটিবিক্স), লিউকোভোরিন ক্যালসিয়াম।
৮. কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার হার
ক্যান্সার বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত ফলাফল থেকে জানা যায় , টিউমার কোলনের ঠিক কোন জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে বেঁচে থাকার হারও নির্ভর করে। যেমন- আমেরিকায় কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের উপরে এক জরিপে দেখা গেছে , টিউমার সৃষ্টির জায়গাটি যদি এসেনডিং কোলনে হয়, তাহলে সে রোগীর কমপক্ষে পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার শতকরা প্রায় ৬৩ ভাগ, আর যদি টিউমারটি ডিসেনডিং কোলনে হয় সেক্ষেত্রে কমপক্ষে পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার গিয়ে দাঁড়ায় শতকরা প্রায় ৬৬ ভাগ, এটা ট্রান্সভারস কোলনে হলে সারভাইভাল রেট হচ্ছে শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ। একই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল থেকে আরো জানা যায় , কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের বেঁচে থাকার হার তাদের দেশের বা মহাদেশীয় অঞ্চলের উপরেও নির্ভর করে। যেমন- আমেরিকায় কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের কমপক্ষে পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার যদি ৬২% হয়, সেই হার ইউরোপের রোগীদের ক্ষেত্রে কমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৩%। এটা হতে পারে। কারণ বিভিন্ন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান বিভিন্ন রকমের এবং ক্যান্সারটি স্ক্রিনিং-এর মাধ্যমে কতো আগে ধরা পড়লো তার উপর অনেকটায় নির্ভর করে বেঁচে থাকার হার। আরো কিছু আনুষঙ্গিক কারণে সারভাইভাল রেট পরিবর্তিত হতে পারে।
জার্নাল অব দা ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের কমপক্ষে পাঁচ বছর বেঁচে থাকার একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে ঠিক নিম্নরূপ :
ধাপ এক কোলন ক্যান্সার : ৯৩%
ধাপ দুই (ক) কোলন ক্যান্সার : ৮৫%
ধাপ দুই (খ) কোলন ক্যান্সার : ৭২%
ধাপ তিন (ক) কোলন ক্যান্সার : ৮৩%
ধাপ তিন (খ) কোলন ক্যান্সার : ৬৪%
ধাপ তিন (গ) কোলন ক্যান্সার : ৪৪%
ধাপ চার কোলন ক্যান্সার : ৮%।
উপরের পরিসংখান থেকে একটা তথ্য আপনাদের মনে খটকা সৃষ্টি করতে পারে। তা হল যে, ধাপ তিন (ক)-এর রোগীদের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার হার (৮৩%) ধাপ দুই (খ) এর (৭২%) চেয়ে বেশি কেন? এর কারণ হিসাবে জার্নালটিতে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাহল – কেমোথেরাপি। ধাপ তিনের রোগীরা সাধারণত কেমোথেরাপি গ্রহণ করেন তবে ধাপ দুইয়ের রোগীরা সচরাচর কেমোথেরাপি নেন না।
ভিন্ন একটি জার্নালে (ANZ Journal of Surgery) প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের উপরে কমপক্ষে পাঁচ বছর ও দশ বছর বেঁচে থাকার হারের উপরে একটি পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে, যা নিম্নরূপ :
পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার : দশ বছর বেঁচে থাকার হার :
ধাপ এক কোলন ক্যান্সার : ৯৩% ৯২%
ধাপ দুই কোলন ক্যান্সার : ৯০% ৮৯%
ধাপ তিন কোলন ক্যান্সার : ৫৯% ৫৬%
এখানে কমপক্ষে পাঁচ ও দশ বছর বেঁচে থাকার যে শতকরা হার বলা হয়েছে, তা ক্যান্সারটি শনাক্তের ঠিক প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণনা করা হয়েছে। তবে অনেক রোগীই পাঁচ বা দশ বছরের চেয়েও অনেক অনেক বেশি সময় বেঁচে থাকেন এবং অনেকে সম্পূর্ণভাবে কিউর বা ক্যান্সার থেকে আরোগ্য লাভ করেন।
পরিশেষে, বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় নাট্যকার, চলচিত্রকার, উপন্যাসিক, কথা সাহিত্যিক, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর ও শহিদুল্লাহ হলের প্রাক্তন আবাসিক এবং আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও কোর্স টিচার, দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. হুমায়ূন আহমেদ- যিনি বর্তমানে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। নিউইয়র্কের জ্যামায়কায় অবস্থিত স্লয়ান অ্যান্ড ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে তিনি দ্বিতীয় দফায় কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। আল্লাহ্র নিকট আমি সর্বান্তকরণে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. হুমায়ূন আহমেদের আশু রোগমুক্তি ও দ্রুত স্বাস্থ্যের উন্নতি কামনা করে এই লেখাটি শেষ করছি।
লেখকঃ ড. মোঃ রওশন আলম, সায়েন্টিস্ট, যুক্তরাষ্ট্র থেকে (একটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল প্রডাক্টস প্রস্তুতকারী একটি ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত)।
e-mail: alamrowshon@gmail.com
বাংলাদেশ সময় ২০৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১২