কলকাতা (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত): ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে রক্ষা পাওয়া কয়েকজন বাংলাদেশির প্রথম সন্ধান দিয়েছিল বাংলানিউজ। রোববার (৪ মে) কলকাতায় দেখা মেলে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে।
তবে যারা দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন, তারা আপাতত আর চেন্নাইয়ে চিকিৎসা জন্য যাবেন না। দেশেই ফিরে যেতেই চাইছেন। চোখের সামনে এত রক্ত, এত মৃত্যু, অসংখ্য মরদেহ দেখে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তাই এখন তারা দেশে ফিরতে যেতে চাইছেন।
শনিবার (৩ জুন) রাতেই ওড়িষা থেকে কলকাতায় ফিরেছেন মো. মিনহাজ উদ্দিন (৩১), মোঃ হুমায়ুন কবির (২৮), মোছা. আজমিন আক্তার (২১)। তাদের তিনজনই ময়মনসিংহের বাসিন্দা। চিকিৎসার জন্য করমন্ডল এক্মপ্রেসে ভেলোর যাচ্ছিলেন। এখন তারা দেশে ফিরতে চান।
মিনহাজ বলেন, আমরা এই তিন বাংলাদেশি বি-থ্রি কামরায় ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ট্রেনে থেমে যায়। চারদিকের ট্রেনের সব লাইট নিভে যায়। এরপরই ট্রেনের ভেতর থেকে চিৎকার আর কান্নার শব্দে কী করব বুঝ উঠতে পারছিলাম না। কয়েকজন যাত্রী কাঁচের
জানলা লাথি মেরে ভেঙে ফেলে। সেই জানলা দিয়ে বের হয়ে আসি আমরা। বাইরে তখন অন্ধকার। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পরই গোটা ট্রেনের চিৎকার কানে আসতে থাকে। আমাদের মত যারা জানলা দিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন তারা মোবাইলের আলো নিয়ে ট্রেনের সামনে যেতেই দেখি চারিদিকে রক্ত আর চিৎকার। কারো শরীরে হাত নেই, কারো মাথার ভেতর দেখা যাছে। এমন দৃশ্য দেখে চোখের পানি থামাতে পরিনি। সবার আগে ছুটে আসেন স্থানীয়রা। ট্রেনের সাদা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে আহতদের নিয়ে ছুটতে থাকেন তারা। তখন চারিদিকে হাহাকার আর চিৎকার। আর আমরা যে কয়জন সুস্থ ছিলাম সবাইকে স্থানীরাই সেই রাতে তাদের বাসায় আশ্রয় দেন। রাত তিনটা পর্যন্ত ছিলাম সেখানে। এরপর আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল নিয়ে যায়।
আজমিন আক্তার বলেন, এত মৃত্যু, রক্তাত্ব শরীর আর চারদিকের চিৎকার আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। ওখানেই জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি এক স্থানীয়র বাসায়। হাসপাতালে যখন নিয়ে যায় তখন দেখি একজন বয়স্ক মানুষকে ডাক্তাররা খাওনার চেষ্টা করছেন। উনি বারবার বলছিলেন আমার নাতি এলে খাব। কিছুতেই খাওয়াতে পারছিল না ডাক্তাররা। হাওড়ার শালিমার স্টেশন থেকে যখন ট্রেনে উঠেছিলাম ওনার সঙ্গে একজন শিশুকেও দেখেছিলাম। আমাদের পাশের কামরাতেই ছিলেন ওনারা। হাসপাতালে আমি ওনাদের ভাষা বুঝতে পারি না। তবে বুঝতে পারছিলাম ওনার নাতি আর বেঁচে নেই। উফ, আমি আর এসব মনে করতে চাই না। শরীর খারপ লাগছে। আজমিন যখন এসব বলছিলেন, তখন তার দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।
রোববারের তথ্য অনুযায়ী বাকি বাংলাদেশিরাও সুস্থ আছেন। রাজশাহীর বাসিন্দা মো. রাসেলুজ্জামান (২৭) দেশে ফিরে গেছেন। পাবনার বাসিন্দা মো. আসলাম শেখ (৩৩), খুলনার বাসিন্দা রুপা বেগম খান এবং ঢাকার দুই বাসিন্দা খালেদ বিন আওকাত (৫০) ও মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন (৩৫), গোপালগঞ্জের বাসিন্দা সাজ্জাদ আলি, মোর্শেদ আলম (৪৫) কুমিল্লার মনসুর আলি সবাই কলকাতায় ফিরে এসেছেন। এছাড়া গাজীপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন, পারভিন আক্তার তারা চিকিৎসার কারণে ভেলোরে গেছেন।
কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস বলেন, আমরা সন্ধান চালিয়েছিলাম আত্মীয় স্বজনদের তথ্যমতে। আমার জানা মতে এই মুহূর্তে করমন্ডল এক্সপ্রেসে সফরকারি বাংলাদেশি যাত্রীরা সবাই সুস্থ আছেন। তবে আমাদের একটা টিম ওখানে এখনও কাজ করছে। কারণ এখনও শনাক্ত হয়নি এমন মরদেহের সংখ্যা ১৮২ জন। তাই আমরা আমাদের যে হটলাইন নম্বর (+৯১ ৯০৩৮৩৫৩৫৩৩) চালু রেখেছি তা আরও এক সপ্তাহ খোলা থাকবে।
প্রসঙ্গত, ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অনেককেই শনাক্ত করা যায়নি। খোঁজ মেলেনি পরিবারের কারও। এসব মরদেহ আরও ভালো করে সংরক্ষণের জন্য সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাজ্যটির রাজধানী ভুবনেশ্বরে। এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওড়িশা সরকার। তাদের মতে এখনও পর্যন্ত ১৮২টি মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি।
সেখানকার মুখ্যসচিব শনিবার (৩) রাতে বলেছেন, উন্নত সংরক্ষণের জন্য মরদেহগুলো ভুবনেশ্বরে নেওয়া হবে। ৪২ ঘণ্টা সংরক্ষিত অবস্থায় রাখা থাকবে সেগুলো। এ সময়ের মধ্যে পরিচিতদের ভুবনেশ্বরে এসে দেহ শনাক্ত করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে যে সব মরদেহ শনাক্ত করা যাবে না, সেগুলি নির্দিষ্ট মেডিকেল পদ্ধতি মেনে সৎকার করবে ওড়িশা সরকার।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, ৪ জুন, ২০২৩
ভিএস/এমএমজেড