ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

পশ্চিমবঙ্গে চায়ের ভাঁড়ে ভোটের তুফান

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৬
পশ্চিমবঙ্গে চায়ের ভাঁড়ে ভোটের তুফান

কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গে তিন দফার নির্বাচন ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলায় নির্বাচন সম্পন্ন হলেও বাকি রয়েছে কলকাতার বড় অংশের ভোটগ্রহণ।

আর এ ভোট নিয়ে চায়ের দোকান, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে কলকাতার মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে ভোটের আলোচনা।

আলোচনার একদিকে আসছে বিগত পাঁচ বছরে শাসক দলের করা উন্নয়নের প্রসঙ্গ থেকে তেমনই আছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের জোট। অন্যদিকে আলোচনায় আসছে বিজেপি’র প্রসঙ্গ। বিগত লোকসভা নির্বাচনে মোদী হাওয়ায় ভর করে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলো বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সেই ধারা বজায় রাখতে পারে কি না এখন দেখার বিষয়।

উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের ‘মধুর চা’ দোকানের মালিক মধুসূদন চাকলাদার (৫১) প্রায় ২৫ বছর ধরে এই চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘চায়ে পে চর্চা’ নাম দিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু কলকাতার মানুষরা অনেক আগে থেকেই চায়ের ভাঁড়ের সঙ্গে রাজনৈতিক চর্চার বিষয়টিকে জড়িয়ে নিয়েছেন। এজন্য মধুর চায়ের দোকান সেই ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে।

তিনি আরো জানান, দোকানে বসে নিরপেক্ষ থাকাই ভালো। তবে দোকানে বসে থাকা সব খরিদ্দারকে তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে চান তিনি। অবশ্য বিতর্ক যখন মাত্রা ছাড়ায় তখন গরম চা পরিবেশন করে তিনি পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করেন।

ওই চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করছিলেন সমীর চট্টোপাধ্যায়। তিন বছর আগে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।

তিনি বাংলানিউজকে জানান, গত বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে পরিস্থিতির আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে এই বিধানসভা নির্বাচনের। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারকে সরিয়ে দেওয়ার যে হাওয়া তৈরি হয়েছিল সেই হাওয়ায় ভর দিয়ে ভোটে জয়ী হয়েছিলো তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু এই বছর তাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে গত পাঁচ বছরে করা তাদের উন্নয়নের নিরিখে।

কলেজছাত্র নিখিল মিত্র বাংলানিউজকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে দুর্নীতি একটা বড় ইস্যু। দুর্নীতি ইস্যু বিগত লোকসভা নির্বাচনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। ঠিক তেমনই ২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দুর্নীতি অন্যতম বড় ইস্যু। একই সঙ্গে তুলে আনেন সারদা কেলেঙ্কারি থেকে নারদ নিউজের স্ট্রিং অপারেশন।

চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছিলেন হিতেন ত্রিবেদী। বাঙালি না হলেও পাঁচ দশক কলকাতায় কাটিয়েছেন তিনি। তিনিও কলকাতার ভোটার। তিনি জানান, কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের কাজকর্মের প্রভাব পড়বে ভোটে। ভালো ফল করতে পারে বিজেপি।

উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার চেহারা একই। দক্ষিণ কলকাতার বেহালা অঞ্চলে বিখ্যাত হারুর চায়ের দোকান। ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি বেহালা অঞ্চলে এই চায়ের দোকান। এখানে নির্বাচনে লড়াই করছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার বিরুদ্ধে জোট প্রার্থী সিপিএম-এর তরুণ নেতা কৌস্তুভ চট্টোপাধ্যায়। দোকানের একদিকে সিপিএম’র কার্যালয়, দোকানের বিপরীতে ইন্দিরা-রাজীব সংহতি কেন্দ্র আদতে কংগ্রেসের কার্যালয়। হারুর দোকানের আরও একটি বিশেষত্ব আছে। সেখানে পাতা চার পাঁচটি কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চগুলোও তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের দখলে থাকে দিনের বেশির ভাগ সময়টা।

হারুর কাছে এবারের ভোটের ইস্যু কি জানতে চাইলে তিনি আঙুল দেখিয়ে দিলো বেঞ্চে বসে থাকা কয়েকজনের দিকে। কলকাতার চায়ের দোকানে চার-পাঁচটি বেঞ্চ থাকা বর্তমানে এক বিরল দৃশ্য। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলিতে সাধারণত কোনো বসার জায়গা থাকে না। যেগুলিতে থাকে সেগুলিতে একটির বেশি বেঞ্চ দেখা যায় না। হারুর দোকানে বসার জায়গা থাকায় আড্ডাও জমে। হারু একদিকে যেমন সিপিএম কার্যালয় থেকে ডাক পেলে চা নিয়ে ছুটে যায় ঠিক তেমনই কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদেরও চায়ের পিপাসা নিবারণ করতে সদাই ব্যস্ত সে।

হারুর দোকানে বসে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী রাজা নাথ বাংলানিউজকে জানান, কলকাতা শহরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কতটা পরিবর্তন হয়েছে।

কলকাতাকে লন্ডন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, লন্ডন কি হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে রাজা বলেন, মাত্র পাঁচ বছর সময়ে কলকাতাকে যেভাবে সাজানো হয়েছে সেটা প্রতিটি মানুষের চোখে দেখতে পাচ্ছেন। তাছাড়াও গ্রামের মানুষের অনেকটা উন্নতি হয়েছে তৃণমূল সরকারের আমলে।

এ সময় রাজার বক্তব্যের বিরোধিতা করলেন দীপক অধিকারী। তিনি বাংলানিউজকে জানান, কলকাতার উড়াল সেতু ভেঙে পড়া, মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা বৃদ্ধি, আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের নাম জড়িয়ে যাওয়া জনমানসে প্রভাব ফেলবে।

ভোটে কি বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের জোট ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে চা খেতে আসা বিপুল রায় বাংলানিউজকে জানান, জোট একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’। তার কারণ বিরোধী ভোট এক জায়গায় আসলে শাসক দল সমস্যায় পড়বে। তবে সেটা সরকার পরিবর্তনে কতটা সহায়তা করবে সেটা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

দক্ষিণ থেকে এবার পূর্ব সল্টলেক এলাকা। সল্টলেক এলাকায় পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকান খুঁজে পাওয়া কঠিন। সল্টলেকের  করুণাময়ী বাস টার্মিনাল এ অঞ্চলের অন্যতম বড় বাস টার্মিনাস। এখান থেকে বাংলাদেশ যাওয়ার বাসও ছাড়ে। এছাড়া আছে কিছু দূরপাল্লার বাস। শহরের ভেতরে চলাচলকারী অনেক বাস ছাড়ে এই জায়গা থেকে।

এই বাস টার্মিনাসের কাছেই কলকাতার বিখ্যাত আইটি ক্ষেত্র। এর ফলে এখানে পাওয়া গেল বেশ কিছু আইটি কর্মচারীকে। চায়ের দোকানে তাদের ভিড় জমানোর কারণ, বাড়ি ফেরার পথে একটু চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেওয়া। সেই চায়ে চুমুকের ফাঁকেই অর্ণব মুখার্জি বাংলানিউজকে জানান, শহরের বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু শিল্প ক্ষেত্রে সেই ধরণের কোনো উন্নতি তার চোখে পড়েনি।

তার মতে বড় শিল্প রাজ্যে আসেনি। এর ফলে কাজের বাজারে চাপ বেড়েছে। তবে বড় শিল্প না আসলেও ক্ষুদ্র শিল্পে রাজ্য অনেকটাই উন্নতি করেছে বলে মনে করেন আরেক আইটি কর্মী পারমিতা সাহা। তবে তিনি চিন্তিত মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে। বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনা তাকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে।

কি হতে পারে ভোটে ফলাফল? এই প্রশ্নের উত্তরে অর্ণব বাংলানিউজকে জানান, জোট একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’। বিরোধীদলের ভোট এক জায়গায় পড়লে সমস্যায় পড়বে শাসক দল। তবে এই তত্ত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন আরেক আইটি প্রফেশনাল ইমানুল হক। তার বক্তব্য বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের একে অপরের বিরোধী হিসেবে শুধু একটি প্রজন্ম নয় একাধিক প্রজন্মের লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। তাছাড়া কেরালা রাজ্যে বাম এবং কংগ্রেস মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়াই করছেন। সেক্ষেত্রে নেতারা জোট করলেও নিচু তলার কর্মীরা এই জোটে কতটা খুশি সেটা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। আর এই প্রশ্নই ভোটের ফলাফলের আগাম ইঙ্গিত খুঁজতে সব থেকে বড় বাধা।

কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে মাটির ভাঁড়ে চায়ের সঙ্গে কখনও উঠে এলো তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত মা মাটি মানুষ সরকারের ভালো কাজের খতিয়ান, কখনও সমালোচনা। ঠিক তেমনই উঠে এলো বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের জোটের ইতিবাচক সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে কিছু প্রশ্নও। এই প্রশ্ন এবং উত্তর চলতেই থাকবে, ঝড় উঠতে থাকবে চায়ের কাপে। নির্বাচন শেষ হবে, নতুন সরকার গঠন হবে কিন্তু উত্তর কলকাতার মধুর দোকান আর দক্ষিণ কলকাতার হারুর দোকানে আড্ডা ,গল্প, আলোচনা চলবেই। সময়ের চাহিদা মেনে সঙ্কুচিত হতে পারে এসব দোকানের পরিসর, কমতে পারে কাঠের বেঞ্চের সংখ্যা। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা চায়ের দোকানের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোনো ভাবেই শেষ হবে না । সেকথা ভরসা করে বলাই যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৬
এটিআর/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।