নির্বাচনী প্রচার পর্বে দুই বিরোধী পক্ষ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করেছিলো। ভারতীয় জনতা পার্টির রণকৌশলের ভিত্তি ছিল দেশের সুরক্ষায় মোদী সরকারের অবদান।
একথা বলতেই হয় নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে বালাকোটে জঙ্গি আক্রমণ এবং তার পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহ ভোটের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে অনেকটাই সাহায্য করেছে। কিন্তু স্রেফ একটি ঘটনা দিয়ে জয়ের এই বিপুল ব্যবধানের ব্যাখ্যা করা কঠিন।
দ্বিতীয় কারণ— যোজনা কিংবা উজালা প্রকল্প। এই জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিও যে বিজেপি সরকারের প্রত্যাবর্তনের পিছনে অন্যতম কারণ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যেতেই পারে।
তৃতীয় কারণটি অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য ও ঐক্যবদ্ধ একটি জোট গঠনে বিরোধী পক্ষের ব্যর্থতা। বিজেপি দ্বিতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতাটিকে মোদীকেন্দ্রিক করে তুলতে সফল। এবং সেই নিরিখে বিরোধী পক্ষ জনপ্রিয়তায় তার সমকক্ষ কোনো নেতা বা নেত্রীকে নির্বাচকদের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ।
এটি স্পষ্ট যে রাহুল গান্ধী এখনও বিকল্প প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নন। নেতৃত্ব শূন্যতা যদি একটি কারণ হয়, অন্যতম কারণ বিরোধী পক্ষের অভ্যন্তরেই নানাবিধ ফাটল।
বিজেপি এককভাবে যথেষ্ট বলশালী হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত গতিতে একাধিক রাজ্যে জোট গঠন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে যাদের জন্য জোট গঠন জরুরি ছিলো এই ভোটে, সেই বিরোধী পক্ষ যতটা গর্জেছে, ততটা বর্ষায়নি।
এর কারণ বিরোধীরা কোনো যৌথ কর্মসূচির বার্তা, ভারতের রাজনীতিতে যা ‘কমন মিনিমাম পোগ্রাম’ বলে বেশি পরিচিত সেটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি।
এবার আসি পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলাফলে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্মরণীয় হয়ে থাকার অনেকগুলি কারণের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অগ্রগমন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৎকালীন মোদী হাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে ২টি আসন বিজেপি পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ অনেকটাই কম ছিলো।
এবারের লোকসভা ভোটে তাদের আসন সংখ্যায় সেই আভাসটিই বাস্তবে রূপায়িত হল। আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, এবারের ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের অবলুপ্তি। এই নির্বাচনে স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তারা কার্যত প্রত্যাখ্যাত। ঠিক যেমন ভারতের রাজনীতিতেও তারা প্রান্তিক হয়ে গেছে।
বামেরা আলোচনার বাইরে চলে যাওয়াতে বাম ভোট পড়েছে বিজেপিতে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মমতাবিরোধী হিসেবে বামেদের নয় বিজেপিকে যোগ্য দল হিসেবে মনে করেছে।
অন্যদিকে মমতার ‘পপুলিস্ট’ রাজনীতির সুফলটুকুও সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাবার আগেই অনেকটাই স্বজন পোষণের জন্য বেহাত হয়ে গেছে। সেই হিসেবে দেখলে তৃণমূলের যে ভোটটুকু বেড়েছে সেটা বাম ও কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোট।
অন্যদিকে কংগ্রেসে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং রাহুল গান্ধী ও মমতার ‘নরম হিন্দুত্ব’ বাতিল করে হিন্দু ইস্যুকে সামনে রেখে ভোটাররা কট্টর হিন্দুত্বকেই বেছে নিয়েছে।
এছাড়া গোটা ভারতের নিরিখে এবারে বিজেপির উত্থান অন্যতম দুটি কারণ। এক. গান্ধী পরিবারের পরিবারতন্ত্র। উচ্চ স্থানীয় পদগুলো কখনই তাদের পরিবাবরের হাতের বাইরে ছাড়তে চায় না। এতে তাদের কর্মী সমর্থকদেরও একটা ক্ষোভ কাজ করে, এমনই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পরিবারতন্ত্রের বিষয়টি ১৩৫ কোটি মানুষ খুব একটা ভালো চোখে এবার দেখেনি।
অন্যদিকে মমতার নেতৃত্বে ২২টি আঞ্চলিক দলের জোট বা ফেডারেল ফ্রন্টে কে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী সেই মুখ তারা সামনে আনতে পারেনি।
এর পাশাপাশি ফেডারেল ফ্রন্টের নেতৃত্বসহ কংগ্রেসের মধ্যে একাধিক নেতার দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। তাতে বিজেপির নোটবন্দীসহ সাম্প্রদায়িক অশান্তির বিষয়গুলো চাপা পড়েছে ভোটের আগে। কারণ, ভারতীয় জনগণ সম্ভবত এটাই মনে করেছে আর যাই করুক বিজেপির উচ্চস্থানীয় নেতাদের মধ্যে দুর্নীতির দাগ নেই।
এর পাশাপাশি এবারে ১৮ কোটি তরুণ ভোটার, যাদের সেভাবে কোনো ধারণাই নেই গুজরাট দাঙ্গা বা বাবরি মদজিদ ভাঙার অশান্তির দিনগুলোর ব্যাপারে।
এছাড়া ভারতীয় প্রান্তিক মানুষ; যারা এক সময় শৌচকর্ম মাঠেই সারতো, সেদিকে জাতপাত ধর্ম না দেখে সরকারি খরচে বাড়ি প্রতি শৌচ ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং এসব মানুষের কাছে কম খরচে রান্নার গ্যাস পৌঁছে দেওয়া— এসব ইস্যু এবারের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে গেছে।
এর ফলেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গসহ পুরো ভারতে তাদের জায়গা পোক্ত করে নিয়েছে। আগামীতেও এই ধারা চলতে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর এই ধারা চলতে থাকলে সম্ভবত ২০২১ সালে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী পদও মমতার খোয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৩ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৯
ভিএস/এমজেএফ