ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প

সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে জাহাজনির্মাণ শিল্প

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১৭
সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে জাহাজনির্মাণ শিল্প জাহাজনির্মাণ শিল্প, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরিশাল: এক যুগেরও বেশি সময় আগে হয়েছে বিভাগ ঘোষণা, তবু বরিশালে উন্নয়ন আশানুরূপ নয়। গড়ে ওঠেনি উল্লেখযোগ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান।তবে ব্যতিক্রমও আছে। গত প্রায় এক দশক ধরে জাহাজনির্মাণ শিল্প দক্ষিণাঞ্চলে সম্ভাবনার পথ দেখিয়ে আসছে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে এই জাহাজনির্মাণ শিল্পটি। গত প্রায় ৩০ বছরে এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি শিপইয়ার্ড।

এগুলোতে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল যাত্রীবাহী লঞ্চ, কার্গো জাহাজ, কোস্টার ও অয়েল ট্যাংকার নির্মাণকরা হচ্ছে। এসব  শিপইয়ার্ড কিছুটা হলেও বেকারত্ব দূর করতে ভূমিকা রাখছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা রাখেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। মাওয়ায় পদ্মাসেতু আর পটুয়াখালিতে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে এই জাহাজনির্মাণ শিল্পের  চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এমনটাই আশাপ্রকাশ করেছেন বিনিয়োগকারীরা।

জাহাজশিল্প মালিকরা বলছেন, বরিশালেই এখন বিশ্বমানের জাহাজ তৈরি করা সম্ভব। নদীভাঙন রোধ, গ্যাসের সমস্যার সমাধান করা গেলে আর সহজলভ্য ব্যাংকঋণ পেলে আরো এগিয়ে যাবে বরিশালের জাহাজনির্মাণ শিল্প।
জাহাজনির্মাণ শিল্প, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমসূত্রমতে, বরিশালে সর্বপ্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে, ১৯৬৯ সালের দিকে, ‘খাজা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্স’ নামে একটি ডকইয়ার্ড সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের নয়ানী এলাকায় সাহেবের হাট খালের পাশে তৈরি করা হয়। এটি তৈরি করেন এখানকার বিশিষ্ট লঞ্চব্যবসায়ী সাবেক পৌর চেয়ারম্যান প্রয়াত গোলাম মাওলা।

বরিশালে আধুনিক জাহাজ নির্মাণের ভিতটা তারাই গড়েন ১৯৯৮ সালে কীর্তনখোলা নদীর বেলতলা পয়েন্টে খাজা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্স-২ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেখান থেকেই ২০০২ সালে একই মালিকানাধীন ক্রিসেন্ট শিপিং লাইন্সের যাত্রীবাহী লঞ্চ সুরভী-৪ নির্মান করা হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সুরভী-৬, সুরভী-৭, ও সুরভী-৯ এর মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত লঞ্চ তৈরি করা হয়। পাশাপাশি এই শিপইয়ার্ডে এখন পর্যন্ত তৈরি হয়েছে ৮-১০ টি কার্গো ভেসেল। যেসবের মধ্যে সেভেন সীজ ২,৩,৪ নামে তিনটি কার্গো জাহাজ শিপইয়ার্ডের মালিকপক্ষের নিজেদেরই।

২০০৩ সালে খাজা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্স-এর পাশেই কীর্তনখোলা নদীর তীর ঘেঁষে সুন্দরবন শিপইয়ার্ড গড়ে তুলেছেন বরিশাল চেম্বার অব কমার্স-এর সভাপতি ও লঞ্চমালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু। ঢাকা-বরিশাল ও ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে নিজের মালিকানাধীন অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি সুন্দরবন-৭, ৯, ১০, ১১, ১২ নির্মাণ করা হয়েছে এই শিপইয়ার্ডেই। পাশাপাশি অন্যের মালিকানাধীন বরিশাল-লক্ষ্মীপুর রুটের আধুনিক এমভি পারিজাত নামের জাহাজটিও তৈরি হয় এই শিপইয়ার্ডে। পাশাপাশি এখানেও নিজেদের ও এম.ই.পি কোম্পানির কয়েকটি কার্গো ভেসেল তৈর করা হয়।
সুন্দরবন শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি দূরত্বেই রয়েছে বাগেরহাট শিপ বিল্ডার্স নামের একটি শিপইয়ার্ড। ২০০২ সালে মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌসের মালিকানাধীন ওই শিপইয়ার্ডে তৈরি হয়েছে এমভি কীর্তনখোলা-১ ও ২ লঞ্চ। বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে ৩০৫ ফুট দীর্ঘ ও ফ্যান্টারসহ ৫৯ ফুট প্রস্থের বিশাল একটি যাত্রীবাহি জাহাজ কীর্তনখোলা ১০। এটির নির্মাণকাজ শেষ হলে আরও চারটি পণ্যবাহী জাহাজ নির্মাণ করবেন তারা।

এদিকে ঢাকা-বরিশাল রুটে দিবা ও রাত্রিকালীন সার্ভিসের জন্য একসঙ্গে ৪টি জাহাজ নির্মাণ করে সাড়া ফেলেছে নলছিটির দপদপিয়ায় কীর্তনখোলা নদীতীরে অবস্থিত অ্যাডভেঞ্চার শিপবিল্ডার্স। এই শিপইয়ার্ডটি ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে ৮টি কার্গো ভেসেল ও তেলের ট্যাংকার তৈরি করেছে।
এসব শিপইয়ার্ডের প্রতিটিতেই কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে সম্ভাবনাময় এই শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীভাঙন, গ্যাসের অভাব আর ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতার কারণে। এসব কারণে লক্ষ্য থেকে তারা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন।

অ্যাডভেঞ্চার শিপবিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মোঃ নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা বন্দরকে ঘিরে জাহাজনির্মাণ শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। শুধু পায়রা বন্দরকে ঘিরে যেসব জাহাজের দরকার হবে তা এই অঞ্চলেই তৈরি করা সম্ভব। নদীবেষ্টিত এ অঞ্চলে এখন প্রচুর দক্ষ শ্রমিকও রয়েছে। এখানে জাহাজ নির্মাণে মজুরি, ব্যয় ও কষ্টও তুলনামূলকভাবে কম।

তিনি বলেন, একটা সময় ছিলো যখন চট্টগ্রাম থেকে নয়তো বিদেশ থেকে জাহাজ তৈরি করে আনা হতো। কিন্তু এখন সেই মানের জাহাজ বরিশাল অঞ্চল থেকেই তৈরি করে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। সরকারের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী নতুন কাঁচামাল অনেক কম খরচে আনা যায়। পাশাপাশি বিদ্যুতের ঘাটতি না থাকায় তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে এবং সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভূক্ত ব্যংকগুলো যদি এ শিল্পে বিনিয়োগে সহায়তা দেয় তবে আরো অগ্রগতি ঘটবে।

খাজা শিপবিল্ডার্স ও সুরভী গ্রুপ অব কোম্পানিজ-এর পরিচালক রিয়াজ উল কবির বলেন, এই জাহাজনির্মাণ খাতকে এখনো শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়নি। অথচ এরই মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে জাহাজনির্মান শিল্পের অপার সম্ভাবনা। একটা সময় ছিলো কেউ বরিশালে এসে কাজ করতে চাইতো না, দক্ষশ্রমিক ছিলো না, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ছিল না। এখন সে অবস্থা আর নেই। এখন এখানে অবকাঠামো আছে, পরিবেশ আছে, দক্ষশ্রমিক আছে। তার উপর আবার মজুরি ও আনুষঙ্গিক ব্যয়ও কম।  

তবে তিনি কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরে বলেন, বর্তমান সময়ে নদী ভাঙনের কারণে অনেক শিপইয়ার্ড-ই রয়েছে হুমকির মুখে। খাজা শিপইয়ার্ডের দেড় একর জমি এরই মধ্যে র্কীতনখোলায় বিলীন হয়ে গেছে। নতুন করে জায়গা খোঁজা হচ্ছে। আবার সুন্দরবন ও বাগেরহাট শিপবিল্ডার্স নামের দুটি ইয়ার্ডও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। এসব দিকে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৩২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৭
এমএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।