ঢাকা: ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, বাংলা ভাষার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা, ৩৫ কোটি মানুষের এ ভাষার সব কিছু আমাদেরকেই করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে ইউনিকোডে বাংলা এনকোডিং করার সময় আমরা তার সদস্য ছিলাম না। প্রতিবেশী দেশের বাংলা ভাষাভাষীরা বাংলাকে দেবনাগরীর মতো করে এনকোডিং করে আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। আমরা দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও এর সমাধান করতে পারছি না। এরই মধ্যে বাংলার প্রমিত মান তৈরি করা হয়েছে। বাংলার জাতীয় মান ইউনিকোডের মান হিসেবে নিশ্চিত করতে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে তা পেশ করতে হবে। এ বিষয়ক গঠিত কারিগরি কমিটিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সোমবার (২৭ মার্চ) বিটিআরসি মিলনায়তনে বিটিআরসি ও বিআইজিএফ’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার স্বার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা এবং বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও বিআইজিএফ সভাপতি হাসানুল হক ইনু সম্মানিত অতিথি, সংসদ সদস্য আফরোজা হক রীনা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নিবাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন বিটিআরসি’র মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. এহসান কবীর।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইজিএফ সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুল হক (অনু)।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, বিশ্বের ৩৫ কোটি বাংলাভাষাভাষীর জন্য বাংলাদেশই হচ্ছে বাংলা ভাষার রাজধানী। বাংলাদেশই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলার এনকোডিং ও কিবোর্ডের মান প্রমিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বাংলার ১৬টি টুলস উন্নয়নে ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছেন যার কাজ চলমান। বাংলাদেশে প্রকাশনার জন্য একটিই কিবোর্ড ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়। এখানে আসকি ও ইউনকোডের মধ্যে যে দেওয়াল আছে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তারপরও ইউনিকোড কনভার্সনে যে জটিলতা হয় তার অপরাধ বাংলা ভাষাভাষীদের নয়।
ভাষা ও সাহিত্যের প্রাযুক্তিক সমস্যাটার পেছনে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের দায় রয়েছে উল্লেখ করে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার উদ্ভাবক মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের ভাষাকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে গণ্য না করে আমাদেরকে ‘দেবনাগরীর’ অনুসারী করে প্রচণ্ড রকম ক্ষতি করা হয়েছে। এজন্যই এখনো আমাদেরকে নোক্তা নিয়ে যুদ্ধ করে বেড়াতে হচ্ছে। অথচ বংলা বর্ণে কোনে নোক্তা নেই। ইউনিকোড যদি বাংলাকে বাংলার মতো দেখে এই সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেলতো তাহলে যে সমস্যাগুলো এখন মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা আমরা করতাম না।
দেরি করে হলেও বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যোগ দিয়েছে ২০১০ সালে উল্লেখ করে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার উদ্ভাবক মোস্তাফা জব্বার বলেন, তার আগে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে ভারতীয় ভাষা পরিবারের যে এনকোডিংগুলো করা হয় তখন বাংলাভাষাভাষীরা ভূমিকা নিতে পারলে সংকট অনেকটাই উত্তরণ সম্ভব ছিল। তিনি বলেন, প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আসকি, ইউনিকোড এবং প্রমিতের নির্দিষ্ট মান থাকলেও তার প্রয়োগ না থাকায় স্পেল চেকার, অভিধান, ওসিআর ইত্যাদিসহ বাংলা এনএলপি ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এর প্রয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদেরকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মন্ত্রী ইউনিকোডে বাংলা লিপি ঢ-ঢ়, ড-ড়, য-য়-তে সমস্যা থাকাতে বড় তথ্য বিশ্লেষণ, সার্চ ইঞ্জিন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় এবং ইন্টারনেট অব থিংসে বেশ সংকট দেখা দিচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, মুদ্রণ জগতে রোমান লিপির সঙ্গে বাংলা লিপির এনকোডিং এর ক্ষেত্রে তারতম্য আছে।
মন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ এলাকা ফোর-জি নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। দেশে ২০০৮ সালে সাড়ে সাত জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যবহৃত হতো, বর্তমানে তা ৪১০০ জিবিপিএস এ উন্নীত হয়েছে। তিনি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের একদেশ এক রেট কর্মসূচির ন্যায় মোবাইল ইন্টারনেটের তা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশে দেন।
ইউনিকোডের শুরু ১৯৮৭ সালে অ্যাপল কম্পিউটারের উদ্যোগে। পরে মাইক্রোসফটসহ বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগে যুক্ত হয়ে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম গঠন করে। ১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডে অ্যাপলের একটি সম্মেলনে অংশ নেন আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী এবং বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ইউনিকোডের বাংলায় সে সময় ড়, ঢ়, য় ও ৎ—এই চারটি বর্ণ ছিলই না। মোস্তাফা জব্বার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এগুলো যুক্ত হয়।
হাসানুল হক ইনু বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে কর্মসূচির ফলে গত ১৪ বছরে দেশে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট মানব সম্পদ গড়ে তোলা অপরিহার্য উল্লেখ করে বলেন, চলমান শিল্প বিপ্লবে ডিজিটাল বৈষম্য কাম্য নয়। তিনি বলেন, মানসম্পন্ন ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল দক্ষতা সম্পন্ন মানব সম্পদ এবং প্রযুক্তিতে ভাষার সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা বিষয়ক গৃহীত প্রকল্পটির দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সংসদ সদস্য আফরোজা হক রীনা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নারীদের অংশ গ্রহণের পাশাপাশি তাদের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং বাংলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে ইন্টারনেট কিংবা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
সভাপতির বক্তৃতায় বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বিটিআরসি, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং বিটিসিএলসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে।
আবদুল হক অনু মূল প্রবন্ধে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সংকট তা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১২ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২৩
এমআইএইচ/জেএইচ