ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

টিফিনের টাকা জমিয়ে রোবট বানালো সপ্তম শ্রেণির আলামিন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০২৩
টিফিনের টাকা জমিয়ে রোবট বানালো সপ্তম শ্রেণির আলামিন নিজের তৈরি রোবট হাতে আলামিন ও তার শিক্ষক-সহপাঠীরা

দিনাজপুর: প্রশ্ন করলেই মিলছে উত্তর। সব প্রশ্নের উত্তর নির্ভুল উত্তর দিচ্ছে রোবটটি।

টিফিনের টাকা জমিয়ে এই রোবট বানিয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আলামিন ইসলাম।  

রোবটের বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষমতা দেখে বিস্মিত আলামিনের স্কুল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

দিনাজপুর সদর উপজেলার কাশীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র আলামিন। তার বাসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা পাড়ায়। নয় বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারায় সে। মা আর ছোটভাইকে নিয়ে মামার বাড়িতে থাকে সে। সংসারে অভাব-অনটনের পরেও হাল ছাড়েনি আলামিন। টিফিনের টাকা জমিয়ে তৈরি করেছে রোবট।

সরেজমিনে দেখা যায়, আলামিনের তৈরি রোবটের সঙ্গে কথা বলতে ঘিরে আছে শিক্ষার্থীরা। একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে চলেছে সেই রোবট। সালাম দিলে জবাব দিচ্ছে সালামের। স্বল্প গতিতে চলাফেরাও করছে রোবটটি। ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে সংযোগ করা হয় রোবটটি। এরপর সুইচ অন করে আপনার ইচ্ছে মত করা প্রশ্নের উত্তর দেয় রোবটটি। চলাচলের জন্য চারটি চাকা রয়েছে। বৈদ্যুতিক চার্জের মাধ্যমে চলে রোবটটি। আলামিন তার সবজান্তা রোবটের নাম দিয়েছে ‘জিজ্ঞাসা যন্ত্র’।  

কথা হলে আলামিন ইসলাম বলে, অনেকদিন থেকেই রোবট বানানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। টিফিনের জন্য দেয়া টাকা জমিয়ে বিভিন্ন রকম যন্ত্রাংশ কিনতাম। কিন্তু রোবটটি পরিচালনার জন্য একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোন দরকার যেটা আমার ছিল না। একদিন ক্লাসে আমার রোবটের কথা বললে ম্যাডাম সেটি স্কুলে নিয়ে যেতে বলে। তারপর ম্যাডামের ফোনের সাহায্যে সেটি চালিয়ে দেখাই। সেটি ভালোভাবে কাজ করছে। রোবটটিকে যেকোনো প্রশ্ন করলে সে উত্তর দিতে পারে।

আলামিনের সহপাঠী আফরিন জান্নাত নিশি বলেন, আলামিন যখন প্রথমে আমাদেরকে রোবট তৈরির কথা জানায় তখন আমরা বিষয়টি ম্যাডামকে জানাই। পরে একদিন সে তার রোবটটি স্কুলে নিয়ে এসে ম্যাডামের অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সাহায্যে চালিয়ে দেখায়। আমরা রোবটটিকে যেগুলো প্রশ্ন করেছি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিচ্ছিল। আমরা তো ভাবতেই পারিনি আমাদের সহপাঠী এরকম একটা রোবট তৈরি করতে পারবে। আমাদের অনেক ভালো লাগছে এজন্য। এখন আমরাও আলামিনের কাছে অনেক কিছু শিখতে পারব।

আরেক সহপাঠী রিফাত হোসেন বলেন, আলামিন আগে থেকেই কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করত। এর আগেও সে একটি লাইট, ফ্যান তৈরি করেছিল। লেখাপড়াতেও সে ভালো। আর খেলাধুলাও ভালো পারে বিশেষ করে দাবা খেলা। আমরা সবাই তার জন্য অনেক খুশি। সে আমাদের এবং আমাদের স্কুলের গর্ব।

স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আফরিন আক্তার আশা বলেন, আমাদের ক্লাসে আলামিনের তৈরি রোবটটা নিয়ে এসে সে চালিয়ে দেখায়। আমরা গুগলে যেমন সার্চ করলে প্রশ্নের উত্তর পাই, তার রোবট আবিষ্কৃত রোবট থেকেও প্রশ্ন করলেই উত্তর পাচ্ছি। এটা অনেক ভালো বিষয়। আমরা চাই আলামিন ভবিষ্যতেও আরও ভালো কিছু করুক।

আলামিনের মা মরিয়ম আক্তার বলেন, রাতে পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ ধরে কি কি জানি কাজ করত। আমি জিজ্ঞেস করলে বলত কাজ শেষ হলে বলব। আমি টিফিন খাওয়ার জন্য যে টাকা দিতাম সেগুলো জমিয়ে সে রোবটের বিভিন্ন পার্টসগুলো কিনত। আমাকে বলত যে একটা স্মার্টফোন হলে তার কাজটা হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের অভাবের সংসার, এখনও আলামিনকে ফোন কিনে দিতে পারিনি। পরে সে স্কুলের আপার ফোন দিয়ে রোবট চালাত। এটা আমার মা হিসেবে অনেক ভালো লাগছে যে আমার ছেলে এরকম একটা রোবট তৈরি করেছে। সকলে তার জন্য দোয়া করবেন সে ভবিষ্যতেও যেন ভালো কিছু করতে পারে।

আলামিনের শ্রেণি শিক্ষিকা আজমিরা খাতুন বলেন, ছেলেটা ইলেক্ট্রিক্যাল বিভিন্ন ডিভাইস তৈরি করতে পছন্দ করে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে থাকাকালীন একটি লাইট সিস্টেম চার্জার ফ্যান আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থী হিসেবেও সে বেশ মেধাবী। স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী তাকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে এরকম কিছু তৈরি করতে। আমাদেরও ভালো লাগতেছে আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থী এরকম একটা রোবট তৈরি করেছে।

কাশীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, আলামিনের এই উদ্ভাবন অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকে উৎসাহিত করবে। আমরা স্কুলেও বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভালো কিছু করতে আমরা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু রেখেছি। প্রত্যেকটা স্কুলে আইসিটি তথা বিজ্ঞান ল্যাব ও উন্নত চর্চার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে।

দিনাজপুর সদর উপজেলা বিজ্ঞান ক্লাবের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, এ ধরনের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের পাশে সবসময় আছে। উপজেলা বিজ্ঞান ক্লাবের পক্ষ থেকে আলামিনের রোবট আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।  

আলামিনের রোবট আবিষ্কারের খবরে বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে আলামিনকে উৎসাহিতকরণ ও নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রমিজ আলম।  

কথা হলে তিনি বলেন, তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আলামিনের রোবট উদ্ভাবনকে আমরা অনেক ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি কারিকুলাম সংযোজনের ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে অর্জিত মেধা কাজে লাগাতে পারছে। আলামিনের মধ্যেও সেই চেষ্টা রয়েছে ভালো কিছু করার। আমাদের উপজেলা বিজ্ঞানের পক্ষ থেকে আলামিনকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করা হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২৩
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।