ঢাকা: মহাকাশ ক্যাপ্সুল নামটার সংগেই কেমন একটা রোমাঞ্চকর পরিভ্রমণের অনুভূতি চলে আসে, তাই না? প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, চলুন আমরা জেনে নিই মহাকাশ ক্যাপ্সুল সম্পর্কে ।
স্বাভাবিকভাবে আমরা বলতে পারি যে, মহাকাশ ক্যাপ্সুল হল মনুষ্যবাহী মহাকাশযানের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অংশ যার পাখা বা এমন কিছু নেই যা এটাকে বায়ুমন্ডলে ভেসে থাকতে সহায়তা করবে।
এই মহাকাশ ক্যাপ্সুল এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান ভোস্তক-১ থেকে।
আমরা আলোচনা করব ১২ এপ্রিল ১৯৬১ সাল নিয়ে, যে দিন যাত্রা করেছিল ভোস্তক-১।
দ্বিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই মহাকাশে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। হয়তো এই বিষয়ে এগিয়েই থাকতো জার্মান রকেট বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীরা। কিন্তু জার্মানির পরাজয়ের পর মহাকাশ অভিযান দু’মেরুতে ভাগ হয়ে যায়।
একদিকে এখনকার প্রধান পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন।
মহাকাশ যুগের শুরু হয়েছিল রাশিয়ার প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুত্নিকের মহাকাশ পাড়ি জমানোর মাধ্যমে, আর দিনটা ছিল ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। এর এক মাস পর রুশরা মহাকাশ জয়ের মুকুটে আর একটি পালক যোগ করল মহাকাশে সফলভাবে জীবন্ত প্রাণী পাঠিয়ে, প্রাণীটি ছিল লাইকা নামে একটি কুকুর।
এর মাঝে দু’দেশেই চলছিল ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণা - কি করে মানুষ পাঠানো যায় মহাকাশে, এবারও জয় পেল রুশরা।
সোভিয়েত মহাকাশ কার্যক্রমে ১৯ জন বিমান সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হল, ১৯৬১ সালের ৯ এপ্রিলের মাত্র ৩ দিন আগে ইউরি গ্যাগারিন এর নাম ঘোষণা করা হল, গ্যাগারিনের বিকল্প হিসেবে ছিলেন গেরম্যান টিটভ ।
১২ এপ্রিল ১৯৬১ সাল। ভোস্তক-১ এ ইউরি গ্যাগারিন, সব আয়োজন সম্পন্ন, রুশ মহাকাশ যাত্রার রুপকার সের্গেই কারোলিয়ভ বললেন “ সব কিছু ঠিক ”। তিনি গ্যাগারিনকে শুভ কামনা জানালেন, গ্যাগারিন বললেন রুশ ভাষায় “ পাইয়াখালি” যা বাংলায় অনুবাদ করলে বলতে পারি “আমাদের যাত্রা শুরু । ”
গ্রিনিচ সময় ৬,০৭ , ভোস্তক-১ উক্ষেপিত হল, এর সঙ্গেই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল কাজাখস্তানের বৈকনুর কসমোড্রম।
যাত্রা শুরুর ৬ মিনিট পর সহায়তাকারী রকেটের জ্বালানি শেষ হলে, সর্বশেষ ধাপের মূল রকেটের চালনা শুরু হয়, আর ৪ মিনিট পর এর ও জ্বালানি নিঃশেষ হলে ভোস্তক-১ তার কাংখিত কক্ষপথে স্থাপিত হয়।
রুশ বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি সর্তকতা অবলম্বন করেছিলেন, তার একটি ছিল ভোস্তক-১ এমন ভাবে তৈরি করা যে ১০দিন পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করবে, কিন্তু তার আর দরকার হয়নি।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩২৭ কিলোমিটার উচ্চতায়, ভোস্তক ২৭ হাজার কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছিল। ৮৯ মিনিট পর ভোস্তক বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। ভোস্তক-১ এর দু’টি অংশের একটি ছিল গোলকাকার মডিউল (মহাকাশ ক্যাপ্সুল), এটার ভেতরে ছিলেন গ্যাগারিন।
ভোস্তক যখন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, বেশ কতগুলো প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিলেও গ্যাগারিন বৈকনুর কসমোড্রমের নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে তা অবহিত করেন নি।
ভোস্তক যখন ভূমি থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উচুতে গ্যাগারিন ক্যাপ্সুল থেকে নিক্ষিপ্ত হন এবং প্যারাসুটের সহায়তায় অবতরণ করেন।
এ সময় আর ও একটি মজার ঘটনার অবতারণা হয়, গ্যাগারিন অবতরণ করেন এনগেলস নামক শহরের অদূরে, তখন এক কৃষক ও তার মেয়ে তাকে দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল অপার্থিব কমলা রঙ এর কোনো কিছু একটা প্যারাসুট টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন গ্যাগারিন তাদের অভয় দিয়ে বললেন যে তিনি মহাকাশ পরিভ্রমণ করে ফিরে এসেছেন, তিনিও তাদের মতো রুশ।
ইউরি আলেক্সিভিচ গ্যাগারিন সৌজন্যে রোস-কসমস
মাত্র ১০৯ মিনিটের মধ্যে একজন অপরিচিত বিমান সেনা থেকে বীর বনে গেলেন ইউরি আলেক্সিভিচ গ্যাগারিন।
এ অভিযান মহাকাশ জয়ের দুয়ার খুলে দিল। এর পর আর মানবজাতিকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, আমেরিকা চাঁদে অভিযান পরিচালনা করল, খুব বেশি দিন আগের কথা না, চীন ও মহাকাশে মানুষ পাঠালো। গেল বছর পালিত হল প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযাত্রার ৫০ বছর পূর্তি।
ভোস্তক-১ এ পা দিয়ে গ্যাগারিন সৃষ্টি করলেন ইতিহাস, গ্যাগারিন হলেন প্রথম মানব যিনি মহাশুন্য থেকে আমাদের এই অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবী দেখেছিলেন।
ইউরি গ্যাগারিন এবং ১২ এপ্রিলকে সম্মান জানানোর উদ্দেশে ছোট্ট এ লেখার আয়োজন। এর সংগে আমরাও ছোট্ট একটি স্বপ্ন দেখি- আমাদের নিজেদের মহাকাশ যান থাকবে, আমাদের দেশ থেকেও কোনো এক বীর মহাকাশে পাড়ি জমাবে, দিনটা কি খুব বেশি দূরে? নাহ, আমরা বিশ্বাস করি বেশি দূরে না।
লেখক: প্রভাষক, ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, আইইউবিএটি, উত্তরা
বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৩
জেডএম/সম্পাদনা: সোহেলুর রহমান, নিউজরুম এডিটর