ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

প্রবাসে দেশি সফট কৌশলীদের কদর বাড়ছে

সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৩
প্রবাসে দেশি সফট কৌশলীদের কদর বাড়ছে

পিপল এন টেক। যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার বাজারে এক সফল বাংলাদেশি উদ্যোক্তার কর্মপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভাগ্যোন্নয়নে সফটওয়্যার বিদ্যায় চাকরিযোগ্য করে তুলছেন পিপল এন টেক প্রতিষ্ঠাতা আবুবকর হানিপ। নিউ ইয়র্ক শহরে তিনি ‘হানিপ’ নামেই সুপরিচিত।

বাংলাদেশিদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের হাতছানি সব সময়ই বাড়তি আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে আছে। সেই স্বপ্নের দেশে পৌঁছেও অনেকেই স্বপ্নের খোঁজে গোলক ধাঁধায় পড়ে যান। অনেকেই আবার ডুবে যান হতাশায়। এদের কেউ কেউ ডিভি লটারির ভাগ্যগুনে পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু সেখানে গিয়ে মিলেছে ‘অড জব’।

ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, রেস্টুরেন্ট, পেট্রোল পাম্প, বুক শপ, কফি শপ, ডোর টু ডোর সেলস ম্যান এসব চাকরিকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ‘অড জব’ বলে। দিনরাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘর্মাক্ত পরিশ্রম করেও বছর শেষে ৩০ থেকে বড়জোড় ৫০ হাজার ডলার পারিশ্রমিক মিলছে। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মেধাবীরা যুক্তরাষ্ট্রে বছরে লাখ ডলারের আয়ের কৌশল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের তরুণ সফটওয়্যারবিদেরা দারুণ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। পুরো যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার বাজারে ভারতীয়দের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। অথচ বাঙালি তরুণদের মেধা এ চেয়ে অনেক বেশি। কথাগুলো বললেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর ঢাকা অফিস পরিদর্শনে আসা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি ‘পিপল এন টেক’ প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও আবুবকর হানিপ।

বাংলানিউজে এসে দারুণ উৎসাহিত হয়ে তিনি বললেন, দেশের তরুণেরা এগিয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে কাজ করার দক্ষতা, যোগ্যতা আর সক্ষমতা আছে বাংলাদেশি তরুণদের তা বাংলানিউজ দেখিয়ে দিচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশি তরুণেরা সফটওয়্যার খাতেও নিজের মেধার প্রমাণ দেবে, এটা আমি সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এ জন্য অবশ্য পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ আর কর্মশালার কোনো বিকল্প নেই।

আর এ কাজকে দায়িত্ব ভেবে কাজ করছে মনেপ্রাণে বাঙালি আবুবকর হানিপের প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘পিপল এন টেক’। আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও অচিরেই এ পরিসরকে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন তিনি। অচিরেই বাংলাদেশেও এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে বাংলানিউজকে জানালেন আবুবকর হানিপ।

যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার চাকরির বাজারে হানিপ ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও আধিপত্য দেখতে চান। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার প্রবাসী বাঙালি পিপল এন টেক থেকে চার মাসের পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালো বেতনে প্রযুক্তিবিদের চাকরি করছেন। কেউ কেউ স্বপ্নের ছয় ডিজিট অর্থাৎ বছরে লাখ ডলার বেতনের চাকরিও করছেন সফলতার সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রের একেবারেই সাধারণ সফটওয়্যারবিদের বেতন বছরে ৮০ হাজার ডলারের নিচে নয়। আর সামান্য দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার ছাপ থাকলে এ অঙ্ক এক লাখ ডলার ছাড়িয়ে দেড় লাখ ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। শুধু পেশাভিত্তিক দক্ষতা অর্জন করে অড জব নামক হতাশার বিপরীতে মিলতে পারে লাখ ডলারের চাকরির সুযোগ আর সম্মান।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সফটওয়্যার ক্ষেত্রে চাকরির সহজ কর্মক্ষেত্রগুলো হচ্ছে সফটওয়্যার কোয়ালিটি কন্ট্রোল, অ্যানলিস্ট, বিজনেস সফট অ্যানালিস্ট, ডিবিএ (ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর), রিয়েল টাইম প্রজেক্ট (আরটিএম) এবং সিস্টেম অ্যাডমিন।

এসব সফটওয়্যারের কর্মকৌশল আনায়াসেই রপ্ত করে কয়েক মাসেই হয়ে উঠতে পারেন খুদে সফটওয়্যারবিদ। এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন একেবারেই সহজ হবে, তা কিন্তু নয়। তবে হানিপ বললেন, পেশভিত্তিক প্রশিক্ষণ আর বাস্তব কর্মশালার গুণে এসব ক্ষেত্রে পরিশ্রমী হলে সফল হওয়া কঠিন কিছু নয়। ভারতীয়রা পারলে বাঙালিরা কেন নয়। বরং বাঙালিরা এসব ক্ষেত্রে ভারতীয়দের চেয়েও অনেকটা এগিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবারিত সফটওয়্যার চাকরির বাজারে বাঙালিদের কদর মোটেও তুচ্ছ করা মতো নয়। বরং গর্ব করার মতো এমন উদাহরণে দেওয়া যাবে অনেক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি কমিউনিটিগুলো খুব বেশি তৎপর না হওয়ার পারস্পারিক সহযোগিতা আর উদ্যোগের যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

কিন্তু ভারতীয়দের বেলায় এ অভিযোগ মোটেও প্রযোজ্য নয়। ভারতীয়রা একে অন্যের চাকরির জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বাঙালিরাও কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নতুন আসা প্রবাসীদের সব ধরনের সহায়তা করেন। কিন্তু পেশাভিত্তিক দক্ষতার মানোন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি কমিউনিটিগুলো খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে ফিট (ফিমেল ইন টেকনোলজি) নামে প্রশিক্ষণ শুরু করেছেন হানিপ। ঘরের নারীরা অনায়াসে কাজের ফাঁকে এ প্রশিক্ষণ করে চাকরি পেতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নারীদের চাকরির ব্যাপক সুযোগ আছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালুর কথা ভাবছেন হানিপ।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস কাঠামোয় যাত্রা শুরু করে পিপল এন টেক। শুরুতেই মাত্র কজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালিদের একটি প্রাযুক্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করার উদ্দেশে নিয়েই পিপল এন টেক প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ উদ্যোগে অপ্রত্যাশিত সাড়া হানিপকে আরও উদ্যোগী আর সাহসী হতে মানসিক শক্তি যুগিয়েছে।

এখানে ডিভি জয়ী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আবুবকর হানিপের জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের কথা একটু না বললেই নয়। প্রতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ছুটি (শনি-রবি) এ দুদিনই একটানা ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেন হানিপ। প্রশিক্ষণ দিতেন ভালো জীবনের প্রত্যাশী বাঙালিদের। একটু সচ্ছল প্রবাসী জীবন কে না প্রত্যাশা করেন। নিজের চাকরির পাশাপাশি ছুটির দুদিনে তিনি এ প্রশিক্ষণ দিতেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালিদের জীবনে এখন স্বপ্নের কথা বলছেন হানিপ। যদিও এ স্বপ্নকে খুব দ্রুতই বাস্তবে পরিণত করার কলাকৌশল শেখাচ্ছেন হানিপ। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার বাজারে পিপল এন টেক সনদপ্রাপ্তরা বেশ পরিচিত। আর এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা সুনামের সঙ্গেই কাজ করছেন।

এ পরিসরকে আরও সুবিস্তৃত করতে দেশে-বিদেশে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন হানিপ। এবারের বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথাই জানালেন এ প্রবাস জয়ী প্রযুক্তিবিদ।

একটা সত্য হানিপ ভালোই বুঝেছেন। প্রবাসে শুধু নিজের একার ভাগ্য বদলে প্রকৃত ও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যাবে না। এ জন্য পুরো কমিউনিটিকেই এগিয়ে আসতে হবে। আর এ কাজটাই নিবিড়ভাবে করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হানিপ।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহর ছাড়াও কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে সুনাম আর চাকরির বাজারে পরিচিতি বাড়ছে ‘পিপল এন টেক’ প্রতিষ্ঠানের। ফলে এ উদ্যোগ ক্রমেই একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দিকে আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

ঠিক এরপরেই আসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুমোদন। দেশটির বোর্ড অব এডুকেশনের সনদও কপালে জুটে গেল। এটি স্টেট কাউন্সিল অব হায়ার এডুকেশন ফর ভার্জিনিয়ার সার্টিফায়েড কম্পিউটার ট্রেনিং ইন্সটিটিউট অন্তর্ভুক্ত। এ মুহূর্তে নিউ ইয়র্ক সিটির অথরাইজড এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি হিসেবে কাজ করছে পিপল এন টেক।

এখন অবধি পিপল এন টেকের চারটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। নিউ ইয়র্কের অ্যাস্টোরিয়া ও ব্রুকলিনে ছাড়াও নিউ জার্সি এবং ভার্জিনিয়ায় সব মিলিয়ে চারটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে কাজ করছেন হানিপ।

এসব কেন্দ্রে এখন আমেরিকান, চাইনিজ, রাশান, পাকিস্তান ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এর মধ্যে ভার্জিনিয়া সেন্টারের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থীই বিদেশি। তবে নিউ ইয়র্কে চিত্রটা ঠিক ভিন্ন। এখানে ৯০ ভাগই বাংলাদেশি।

শুধু প্রশিক্ষণ কিংবা দিনব্যাপী কর্মশালা নয়, নিজেদের মধ্যে চাকরি প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা আর কলাকৌশলও বিনিময় হয় পিপল এন টেকে। এ কারণেই খুব অল্প সময়েই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে বাংলাদেশি পরিচালনার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান।

গতানুগতির শিক্ষা পদ্ধতির তুলনায় পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের কদর আছে যুক্তরাষ্ট্রে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনমান পরিবর্তন করা সম্ভব। এ জন্য শুধু সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। উদাহরণ তো এখন খুঁজলেই পাওয়া যায়। তাই শুধু হতাশা নয়, উত্তরণের পথে এগোতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আগ্রহী কিংবা এরই মধ্যে যেসব বাংলাদেশি সেখানে অবস্থান করছেন তারা এ বিষয়ে যে কোনো পরামর্শ এবং সহযোগিতার জন্য আবুবকর হানিপের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এ জন্য (www.peoplentech.com) এ সাইটে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। আর সুনির্দিষ্ট তথ্যের প্রয়োজনে (ahanip@peoplentech.com) এ ঠিকানায় ইমেইলও করা যাবে।

বাংলাদেশ সময় ১৭২৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।