ফেসবুকে ছবি দিয়ে শিশুর ক্ষতি ডেকে আনছেন কি? আপনি বুঝতে না পারলেও, বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সে রকম হুঁশিয়ারিই দিচ্ছেন। তারা বলছেন, আজকের যা মজা কিংব কৌতুক আগামী দিনে শিশুদের জন্য তা ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্ব জুড়েই এখন সমস্যাটি এক রকম। শিশুরা বেড়াতে যাচ্ছে, খেলছে। নিজেদের জগতে কত কিছুই না করছে তারা। পারিবারিক উৎসব আয়োজনেও শিশুরা হয়ে থাকছে অন্যতম অনুসঙ্গ। তাতে ছবি তোলা হচ্ছে, ভিডিও হচ্ছে। স্মার্টফোনের যুগে যা অতি সহজ। আর ছবি তোলা মানেই তা ফেসবুকে পোস্ট। এখনতো ফেসবুক লাইভও চলছে হরদম।
কিন্তু ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনোলজি অ্যান্ড লার্নিং বিষয়ক গবেষক জোয়ান ওরল্যান্ডো এসব মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না। তিনি বরং বলতে চাইছেন, আজ বাবা-মায়েরা ভালোবেসে আদর করে তাদের ছোট্ট শিশুদের যে ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, তা প্রাকারন্তরে শিশুদের ক্ষতিরই কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
দ্য কনভারসেশনে তার একটি নিবন্ধে ওরল্যান্ডো এই ভবিষ্যত বিপদের কারণ প্রকৃতিও ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি বলেন, শিশুদের নানা কাণ্ডকীর্তির ছবি আমরা ফেসবুকে তুলে দিচ্ছি, মজা নিচ্ছি। কিন্তু আয়নাটি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজেকেই প্রশ্নটি করি না কেনো যে, শিশুটির ছবি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার এই অধিকার কি আমাকে কে দিয়েছে?
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য সামনে এনে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকা জানান, প্রতিবছর গড়ে প্রতিটি বাবা-মা তাদের শিশু সন্তানটির অন্তত ২০০ ছবি পোস্ট করেন। সেই হিসেবে পঞ্চম জন্মদিনে পৌঁছার আগেই একটি শিশুর হাজার খানেক ছবি অনলাইনে পোস্ট হয়ে যায়।
এও জানা গেছে, যে বাবা-মায়েরা সন্তানের ছবি পোস্ট দেন না, তাদের আবার কমিউনিটির প্রতিবেশি বন্ধুদের কথা শুনতে হয়। প্রশ্ন ওঠে সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর অঙ্গীকার নিয়েও।
এ যেনো এক নতুন আচরণবিধি। যার মানেই হচ্ছে প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই একটি শক্তিশালী ডিজিটাল পরিচিতি ছেলে বেলাতেই তৈরি হয়ে যাবে, যার স্রষ্টা তারা নিজেরা নয়, অন্য কেউ।
সেলেব্রিটিদের জন্য ভূয়া পেজ তৈরি করে তাদের ছবি পোস্ট দেওয়া, এটা সেটা করা হয়। যা সাইবার জগতে একটি অপরাধ ।
জোয়ান ওরল্যান্ডো ছোট্ট শিশুদের ছবি পোস্ট দেওয়ার বিষয়টিকেও একই চোখে দেখেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের জনসম্মক্ষে সেভাবেই তুলে ধরেন ঠিক যেমনটা তাদের মন চায়। কখনো শিশুটিকে মেধাবী হিসেবে তুলে ধরেন, কখনো বুদ্ধিমান, কখনো আবার বেয়াড়া। কখনো সাজগোজের, কখনো ন্যাংটো। শিশুটি খেতে না চাইলেও তার ছবি ফেসবুকে উঠে আসে নোটসহ আবার হাপুস-হুপুস মেখে-জুখে খেলে সে ছবিও পোস্ট হয়। ঘর এলোমেলো করলে তারও ছবি যায়, মৃদু-মিষ্টি অভিযোগও থাকে।
আপনিই ভাবুন না, আপনার বাবা কিংবা মা আপনার অনলাইন আইডেনটিটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছেন আপনার ধরন-ধারন। নিঃসন্দেহে আপনি তা পছন্দ করবেন না। এর পাশাপাশি ওই সব ছবিতে লাইক কিংবা মন্তব্য পড়ছে। যাতে আপনার কোনই হাত নেই। সেগুলো কিন্তু অনেকটা বাছ-বিচার ছাড়া আমরা হতেও দেই। কারণ তা না হলে দর্শকের সাড়াও মেলে না। তাই যদি হয়, শিশুদের পরিচিতির কাঠামোটা আমরাই সুনির্দিষ্ট করে দিচ্ছি।
আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, ওয়েব কখনোই ভুলে যায় না। আমরা খেয়ালই করি না, কিন্তু এটাই সত্য একবার যা এই ইন্টারনেট জগতে উঠে আসে তা সারা জীবনের জন্য থেকে যায়। শিশুদের জন্য সেটাও একটা বড় বিষয়।
গবেষণা বলছে যে, বাবা-মায়েরা প্রায়শই ডিজিটাল তথ্যের এই দীর্ঘস্থায়ীত্বের কথা ভুলে যান। কিংবা এটা তাদের ধর্তব্যেও থাকে না।
প্রথম গানের ক্লাস কিংবা পড়া শেখার দিনটিতে যে ভিডিওতে ধারন করা হয়ে যাচ্ছে সে নিয়ে শিশুটির কোনও ধারনাও নেই। অথচ তা তারই অগোচরে ফেসবুকে উঠে এটা স্থায়ীত্ব পাচ্ছে। যখন সে বড় হচ্ছে তখন তার সামনে সেই দৃশ্যই হয়ে উঠতে পারে বিব্রতকর।
কারো কারো ক্ষেত্রেতো পৃথিবীর মুখ দেখার আগে থেকেই ফেসবুকে অবস্থান সৃষ্টি হয়ে যায়। এমনকি গর্ভের শিশুটির স্ক্যানিং ভিডিও বাবা-মা নিজেদের বন্ধু, বন্ধুদের বন্ধু, তাদের বন্ধু এমন হাজারো মানুষের সামনে খুলে দেন, যা তাদের নিজেদেরও হয়তো চেনা নয়।
বাবা-মা এই যে যা কিছু করছেন তার সবটাই করছেন ভালোবেসে, সদিচ্ছায়।
তখন তারা মনে করেন, এটা তাদেরই ব্যক্তিগত কিছু যা শেয়ার করলেন। সেসময় শিশুটির জীবন নিয়ে তাদের ভাবনাই কাজ করে না।
এগুলো থেকে কিছু সুবিধাও পাওয়া যায়। যেমন ধরুন আপনি আপনার শিশুকন্যার বিছানা ভেজানোর ছবিটি পোস্ট দিলেন। বন্ধুদের কেউ আপনাকে হয়তো পরামর্শ দিলেন একটা কিছুর যা থেকে এমন সমস্যার সমাধান হতে পারে। অথবা এমনও হতে পারে বন্ধুরা আপনার দুর্দশা থেকে শিক্ষা নিলেন। অনেক বাবা-মাই কমিউনিটির এই সহযোগিতাকে গুরুত্বের সাথে দেখেন।
এখনই হয়তো বলার সময় আসেনি এই কাজগুলো শিশুদের প্রাইভেসি, নিরাপত্তা ও নিরাপদ জীবনকে বাধাগ্রস্ত করবে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আজ যেমন আছে আগামীতেও থাকবে। আর দেখতে দেখতে ফেসবুকের বয়স কিন্তু ১৪ বছরে পড়েছে। সুতরাং শুরুর দিনগুলোতে যারা শিশু ছিলো তারা কিন্তু এখন বড় হয়ে উঠছে।
তাহলে এখন চিন্তা করার সময় এসেছে কিভাবে ব্যক্তি (শিশু ও বয়ষ্ক) উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ারিংয়ে একটা সীমারেখা টেনে দেওয়া যায়। আর যেসব তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে সেগুলোর ওপর শিশুদের নিজেদেরও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা যায়। অর্থাৎ যখন তারা চাইবে তখন যেনো নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের প্রয়োগ এসব কনটেন্টের ক্ষেত্রে ঘটাতে পারে।
অনুমতি ছাড়া অন্যের বিব্রতকর কোনও ছবি পোস্ট করা নিঃসন্দেহে অপরাধ, অগ্রহণযোগ্য। তবে বিব্রত হওয়া না হওয়া ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়, তাতে বিষয়টি হয়ে ওঠে আরও জটিল।
এ অবস্থায় কী করণীয়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতটা পারা যায় শিশুদের অংশগ্রহণটা বাড়ানো। শিশুদের কাছেই শুনুন না ওরা কি পছন্দ করছে। ওদের ভাবনাটা কি?
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় শিশুদের ও বাবা-মায়েদের উভয়পক্ষকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা কোন ধরনের নীতি পছন্দ করে।
তাতে বয়ষ্করা বলতে চেয়েছেন, তারা চান এ নীতিতে শিশুরা কতটা সময় এসব ডিভাইস নিয়ে থাকতে পারবে তা থাকা জরুরি। কিন্তু বাবা-মায়েদের চেয়ে অন্তত তিনগুন বেশি সংখ্যক শিশু বলেছে, বাবা-মা সামাজিক মাধ্যমে কি শেয়ার করছেন কি না করছেন সে ব্যাপারে একটা নীতি থাকা জরুরি।
অনেক শিশু এও বলেছে, তাদের না জিজ্ঞাসা করে বাবা-মায়ের উচিতই নয় তাদের কোনও কিছু অনলাইনে পোস্ট দেওয়া।
তবে শিশু ও বাবা-মা উভয় পক্ষই ভালো ভালো ঘটনা, ভালো খবর ভালো অনুষ্ঠান এসবের ছবি তথ্য পোস্ট দেওয়ার পক্ষে। নেতিবাচক কোনও কিছু সামাজিক মাধ্যমে না দেওয়ার পক্ষে তারা।
শিশুটি পার্কে খেলা করছে এমন ছবিতে কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু খাবার খেতে বাহানা করছে সে দৃশ্য ইউটিউবে দেখতে শিশুরা অবশ্যই চাইবে না।
যারা শিশুদের জ্বালাতন নিয়ে কষ্টে আছেন, তাদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে শিশুর ছবি কিংবা নাম ফেসবুকে পোস্ট করবেন না। তবে সমস্যা তুলে ধরে সমাধান অবশ্যই চাইতে পারেন।
শিশুটির কাছে জিজ্ঞেস করে নেওয়া একটি সমাধানের পথ হতে পারে।
শিশুরা ছবিটি পছন্দ করছে কি না? আর তা ফেসবুকে পোস্ট দিতে তার কোনও আপত্তি আছে কি না? সেটা জেনে নেওয়া খুব একটা জটিল বিষয় নয়। সহজ কিছু আলাপচারিতায়ই তা সেরে নেওয়া যায়। এতে শিশুরা ডিজিটাল এটিকেটটাও শিখতে পারে।
বাংলাদেশ সময় ০৮৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এমএমকে