আইফোন ফোরএসের সেটটি অবশেষে দু’বছরের জন্য হাতে এসেছে। দু’বছরের প্ল্যানতো! সে কারণে এমন একটু নির্দিষ্ট করা বলা।
ফোনের গল্পে ফিরে আসি। বাংলাদেশে আমাদের প্রথম দেখা মোবাইল ফোনের নাম মোর্শেদ খানের সিটি সেল। ইয়াবড় কমিউনিকেশন্স রেডিওর মতো ছিল দেখতে। রিকশায় যাবার পথে সেটি হাতে নিয়ে ভাগ্যবান মোবাইলওয়ালার (!) গল্প করাকে কেন্দ্র করে তা তখন মিডিয়ার ছবি, ঈদের ‘ইত্যাদি’তে হাস্য কৌতুকের বিষয়ও হয়েছে! এর চেয়ে বড় বিষয়টি ছিল সেটি নিয়ে তখনকার মনোপলি ব্যবসা! বিএনপির মোর্শেদ খানের মোবাইল ফোনের ব্যবসা যাতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী-নিরুদ্বেগ চলে, সে কারণে আর কোনো অপারেটরকে তখন লাইসেন্সও দেওয়া হয়নি।
এরপর আসে গ্রামীণফোন। কিন্তু শুরুতে এটিও অনেকের কাছে অধরা ছিল। নব্বুই দশকের শেষের দিকে রিপোর্টিংয়ে মিশর-জর্দানে তিনমাস কাটিয়ে দেশে ফেরার পথে সিঙ্গাপুরে ট্রানজিটের সময় স্কুলের পোলাপানের হাতে হাতে মোবাইল ফোন দেখি আর মনে মনে ভাবি, এমন ফোন আমাদের হাতে উঠবে কবে! ঢাকায় ফিরেই অবশ্য পেয়ে যাই তেমন স্বপ্নের একটি ফোন! রিপোর্টিংয়ের জন্য দুটি ফোন কেনা হয়েছিল অফিসে। এর একটির হেফাজতকারী বনে গেলে ব্যতিক্রমী মোবাইলওয়ালা রিপোর্টার হিসাবে যেন এক-আধটু ভাবও আসে মনে! ফোন অফিসের, বিল দেবে অফিস, অতএব নো চিন্তা। তবে যে সেটটা দেয়া হয়েছিল, সেটি সিটি সেলের সেই ইয়াবড় রেডিও মার্কা না হলেও ছিল অনেকটা তার বাচ্চা কিসিমের। আজকালকার ছেলেমেয়েরা শরমে তা হাতেও নেবে না।
মোবাইল ফোন নিয়ে তখন ঢাকার মিডিয়ায় অনেক কাহিনীও হয়। স্বরাষ্ট্র কাম টেলিফোনমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গ্রামীণফোনওয়ালারা সম্ভবত তাকে বেশকিছু ফোন দেয় অথবা তিনি তাদের কাছ থেকে কিনে নেন। সেগুলো তিনি বিলি করেন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে। মিডিয়ায় তখন নাসিম সিন্ডিকেট বলে মজার একটা সিন্ডিকেট অথবা টার্মও ছিল। এসব সাংবাদিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল মন্ত্রীর। সে সূত্রের মন্ত্রীর মাধ্যমে পাওয়া ফোনের আরেক নাম হয়ে গিয়েছিল নাসিম ফোন! মোবাইল ফোন নিয়ে শুরুর দিকে এমন আরও নানান মজার ঘটনা-গল্পের সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রামীণফোনকে কেন্দ্র করে গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-বাজারে গড়ে ওঠে ছোটবড় নানান কলসেন্টার, ফেক্সিলোড, ফোন করার দোকান। গ্রামীণফোনের ইনকামিং-আউটগোয়িং কলচার্জ নিয়ে ক্ষিপ্ত পাবলিকের মতো সরকারের সঙ্গেও কোম্পানির বেশ কাইজ্যা হয়। এ নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হলে কোম্পানি তথা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে সরকারের কাছে কয়েকজন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠিও আসে। চিঠিতে বলা হয়, ড. ইউনূস তাদের বন্ধু মানুষ। সরকার যেন তার দিকে খেয়াল রাখে। সেই ড. ইউনূস পরে আর গ্রামীণফোনের সঙ্গে থাকেননি বা থাকতে পারেননি। সরকারের সঙ্গে তার আজকের কাইজ্যাও নতুন নয়। ব্যবসার মুনাফার স্বার্থে দেশের মানুষ বা সরকারের বিরুদ্ধে তিনি এমন আগেও তার মার্কিন বন্ধুত্বের প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছেন!
এখনতো দেশে অনেক অপারেটরের ফোন আছে বাজারে। সবকিছুর ডিটেলস জানি না। তবে মনে পড়ে দেশের বাজারে প্রথম স্মার্ট সেট আসে নকিয়া কোম্পানির। ভারতীয় একটি বিজ্ঞাপনও তখন অনেককে নকিয়ার পক্ষে টানে। এক জুটি হলের অন্ধকারের মধ্যে সিনেমা দেখছিলেন। হঠাৎ রিং আসতেই অন্ধকারে মায়াবি আলোর আভা তৈরি করে নকিয়ার সেট। বাংলাদেশে মোবাইল কোম্পানিগুলো ব্যবসার প্রসারে তাদের বিজ্ঞাপনে দেশের ঐতিহ্য, সঙ্গীতকে ভূয়সী প্রশংসার মতো কাজে লাগিয়েছে। লঞ্চে গ্রামে মায়ের কাছে যেতে যেতে গান-লিরিকের ছন্দে চঞ্চল চৌধুরীকে নিয়ে গ্রামীণফোনের সেই অ্যাড অথবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খানকে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চুদের ‘এমন মা’কে হাজার সালাম’ শিরোনামের বাংলালিংকের অ্যাডটির কথা এখনও খুব মনে পড়ে।
এবার অস্ট্রেলিয়ার মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কথায় আসি। সাজানো সুন্দর এই দেশের চোখধাঁধানো শপিংমলের মনোহরণ ফোনের দোকানগুলোর ভিতরটা যে অত মনোহরণ না তা এদেশের লোকজন ভালো জানেন। দেশ থেকে অনেকে অনেক সময় আইফোন। মোবাইন ফোনের সেট চান। কিন্তু ফোনের সেট নানান দোকানে বিক্রি হলেও আইফোন এদেশে নির্দিষ্ট অ্যাপেল শপ ছাড়া বিক্রি হয় না বা সিংহভাগ লোকেরা এর দামও জানেন না। এমন কথা বললে দেশের অনেকে অনুরোধের উপহারটি দেব না বা দিতে চাইছি না মনে করে রাগ-অভিমান। কিন্তু আসলে এটিই এদেশের সত্য।
আইফোন থ্রি, ফোর বা ফোরএস এদেশের যাদের হাতে আছে এর সবই মূলত পোস্টপেইড প্ল্যানফোনের। এর সবই আবার ২ বছর মেয়াদি। এই প্ল্যান মাসিক ২৯ ডলার থেকে শুরু করে ১০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এমন ১০০ ডলারের একটি প্ল্যান কাউকে গিয়ে দিতে পারলে ২ বছরে নিয়ে যাবে ২৪০০ ডলার অথবা এরও অনেক বেশি! এদেশের যদি আপনি নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা হন বা সঙ্গে দু’বছর মেয়াদি ভিসা থাকে যে কোন ফোনের দোকানে গেলে আইডেনন্টিটি চেক করে আপনার সই-সাক্ষর, ব্যাংকস ডিটেইলস রেখে ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে ঝকঝকে নতুন একটি আইফোন ধরিয়ে দেবে। নগদ কিছুই দিতে হবে না। এরপর মাসে মাসে আপনার প্ল্যানের মাসিক কিস্তির টাকার বিল হেঁটে হেঁটে চলে আসবে আপনার ঠিকানায় অথবা ব্যাংক থেকে কেটে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ টাকা আপনাকে দিতেই হবে। না দিয়ে যাবেন কোথায়! অথবা এদের মানুষজন নিজস্ব ক্রেডিট হিস্ট্রি সফেদ-সাফসুতরো রাখতে কোথাও কখনো বিলখেলাপি হবার চেষ্টাও করে না। এদেশের সবার সব রেকর্ড থাকে অনলাইনে। কাজেই কোথাও কেউ বিলখেলাপি হয়েছেনতো মরেছেন! সেটির পেমেন্ট ক্লিয়ার না করা পর্যন্ত আর কোথাও কোনও সুযোগ পাবেন না।
আইফোন আবার একটা চলমান স্টোর, দোকান। সারাদিন এটা সেটা অফার করে। আপনি না বুঝে টাচ স্ক্রিনে টাচ দিলেই মরেছেন। আপনি আর আপনার বাজেটের মধ্যে থাকতে পারবেন না। আর আইফোনের নানা বিষয় এমন যে প্রিপেইড কার্ড ব্যবহার করে আপনি এতে মজা পাবেন না। আপনি ছবি তুলে সেটি কোথাও পাঠিয়েছেন বা মেইলচেক বা নেটইউজ করেছেনতো মরেছেন। পটপট করে আপনার প্রিপেইড সব ক্রেডিট কেটে নিয়ে যাবে। অতএব আইফোনের সঙ্গে মাস্ট একটা পোস্টপেইড প্ল্যান থাকা চাই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার এসব দু’বছরের প্ল্যানে বাঁধা পড়া লোকজন জানেন, এগুলো কত বেনিয়া স্বভাবের!
আমার আগে এদেশের অপটাস ফোন কোম্পানির মাসিক ৯৯ ডলারের ‘টাইমলেস’ নামের একটি প্ল্যান ছিল। বাংলাদেশে যেমন টিএ্যান্ডটি সব ফোনের মাদার কোম্পানি, এদেশের তেমন ফোনের মাদার কোম্পানি টেলস্ট্রা। টেলস্ট্রা থেকে লাইন-অবকাঠামো ভাড়া নিয়ে অপটাস, ভোডাফোন সহ নানা কোম্পানি গ্রাহক ধরতে চটকদার নানা অফার দেয়। আমার অপটাসের প্ল্যানের মোবাইলে অস্ট্রেলিয়ার যে কোন মোবাইলে বা ল্যান্ডলাইনে আনলিমিটেড কল-টেক্সট-এমএমএস করার সুযোগ ছিল। ভয়েসমেইলের চার্জ আলাদা। সঙ্গে মাসিক ইন্সুরেন্স ফী ১৩ ডলার। কিন্তু শুরু থেকে মাসিক বিল আসছিল ১৪০ ডলারের বেশি। কাষ্টমার সার্ভিসে ফোন করলে বলে আমি ভয়েসমেইল ব্যবহার করাতে বাড়তি চার্জ হয়েছে। আসলে নিজের থেকে কখনও কাউকে ভয়েস মেইল করিনি। টাচ স্ক্রিনে ভয়েস মেইলের জায়গাতে টাচ পড়ে যাওয়াতে সেই বাড়তি বিল। এরপর আইফোনের ওই প্রোগামটি অফ করে রাখতে হয়।
এদেশের ফোনের ইন্সুরেন্স দাবি করার পর আবার ৫০ ডলার একসেস ফি দিতে হয়। এরপর ফোনসেট জমা নিয়ে সেটির সমস্যা সারিয়ে ফেরত দিতে ১০ কর্মদিবসের কথা বললেও প্রায় ২ সপ্তাহ সময় নেয়। একবার কেউ আইফোনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে অর্ন্তবর্তী সময়টায় অন্য ফোন ব্যবহারে সমস্যার মনে হয়। এভাবে হাতের মোবাইলের মাসিক খরচ ১০০ ডলারের বেশি, ঘরের ল্যান্ড লাইন কাম ইন্টারনেট ১০৯ ডলার, দেশে-বিদেশে ফোনে কথা বলার ফোনকার্ডের খরচ, টেলিভিশনের ফক্সটেল লাইনের মাসিক ৬০ ডলার, সাপ্তাহিক বাড়িভাড়া প্লাস গাড়ির পেট্রোল খরচ প্রায় ৪০০ ডলার, খাবার-দাবার, স্টেশনারিজ-মেহমানদারির সাপ্তাহিক খরচ কমপক্ষে ২০০ ডলার, ত্রৈমাসিক বিদ্যুৎ বিল কমপক্ষে ৬০০ ডলার, এমন একজন বাসিন্দার জীবনের পদে পদে নানান রকমের খরচ। এর মাঝে একটু অসতর্ক চললে ঠিকানা ধরে চলে আসে গাড়ির পেনাল্টি নোটিশ। এসব নিয়ে বলা হয় কাজ করলে এদেশের নাগরিকদের নিরাপদ আয় থাকলেও সবাইকে চলতে হয় টানাটানির মধ্যে।
আমার মোবাইল ফোনের প্ল্যান নভেম্বরে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লোকজন নতুন নানা অফার নিয়ে গত আগস্ট থেকেই যোগাযোগ করা শুরু করে দিয়েছিল। প্রথম থেকে চলছিল আইফোন ফাইভের অফার। সেটি আসছে না দেখে পরে তা আইফোন ফোরএস’এ তা রূপান্তরিত হয়। কিন্তু এর মাঝে আরেক কোম্পানি ভোডাফোনের আরেক প্ল্যানে মনস্থির করার কথা বললে তারা দমে যায়। আইফোনের ফোরএস ৩২জিবি সেটের ইনফিনিট নামের ভোডাফোনের ১০০ ডলারের প্ল্যানে চলতি সব সুবিধার সঙ্গে বাংলাদেশ সহ যেকোন দেশে আনলিমিটেড এসএমএস, এমএমএস করা যাবে। নিজের জন্য এই সুযোগটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ! ওভারসিজ এসএমএস-এমএমএস সুবিধা দেয় না বা দিতে পারবে না বলে হাল ছেড়ে দেয় নিজস্ব সাবেক অপারেটর অপটাস। অতএব নতুন অপারেটরের প্ল্যান সহ দু’বছরের জন্য হাতে চলে এসেছে ঝকঝকে নতুন একটা সেট! বিপদ হলো এর মাঝে আইফোন ফাইভ বা আরও উন্নত কিছু বাজারে চলে এলে সেটি নিতে গেলে এসব বেনিয়াদের হাতে তুলে দিতে হবে আরও কমপক্ষে ৬৫০ ডলার! সাধ আর সাধ্যের দ্বন্দ্বের এসব নিয়েই আমরা আছি অস্ট্রেলিয়ায়! জানতে ইচ্ছে করে পোস্টপেইড ফোন প্ল্যানের এসব বিষয়ে কেমন আছে আমার বাংলাদেশ? আগের বেনিয়া স্বভাবগুলো কী বদলেছে?
ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক