ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ভারী বৃষ্টিতে গাজায় দুর্দশার চিত্র আরও করুণ হলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩
ভারী বৃষ্টিতে গাজায় দুর্দশার চিত্র আরও করুণ হলো

রাতের ভারী বৃষ্টি আর ঠান্ডা বাতাস গাজায় বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে এখন তাদের জীবন কাটছে পাতলা আর ভিজে যাওয়া তাঁবুতে গাদাগাদি করে।

খবর আল জাজিরার।  

রাফাহ শহরে বালুকা ভূখণ্ডে একটি ক্যাম্প। চারদিকে আবর্জনা ছড়ানো। দুর্দশার রাতের অভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছেন ক্যাম্পে আশ্রিতরা। পানির গর্ত ঢাকতে কাউকে কাউকে ঝুড়িতে বালি নিতে দেখা গেল। কেউ আবার ভেজা কাপড় টানিয়ে দিচ্ছেন।

কিছু পরিবারের কাছে উপযুক্ত তাঁবু রয়েছে। বাকিদের পাতলা পলিথিনের তাঁবু। এর মধ্য দিয়েই দেখা গেল আশ্রিতরা মালামাল রক্ষা করছেন। অনেক তাঁবুর নিচের অংশ অনাবৃত, ভেতরে থাকা লোকেদের ভেজা বালিতেই রাত কাটাতে হয়েছে।  

আজিজা আল-শাবরাবি তার তাঁবু থেকে বৃষ্টির পানি সরানোর বৃথা চেষ্টা করছিলেন। এতে দুই সন্তানসহ এ নারীর অনিশ্চিত জীবনযাত্রার চিত্রই ফুটে ওঠে।  

৩৮ বছর বয়সী আজিজা বলেন, তীব্র ঠান্ডায় আমার ছেলে অসুস্থ, আমার মেয়ে খালি পায়ে। যেন আমরা ভিক্ষুক। কেউ গ্রাহ্য করে না, কেউ সাহায্য করে  না।  

ইয়াসমিন এমহানি নামে এক নারী বলেন, তিনি রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান তার সাত মাস বয়সী শিশু ভিজছে। তাদের পাঁচজনের পরিবার একটি কম্বল ভাগাভাগি করেই তাঁবুতে থাকছেন। ইসরায়েলি হামলায় তাদের এক সন্তান মারা যায়, সঙ্গে তারা সম্পত্তিও হারান।  

তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ভেজা কাপড় ছড়িয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন, আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের সন্তান শহীদ হয়েছে। আমি এসবের মুখোমুখি হয়েছে। এক টিশার্টেই আমাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালাতে হচ্ছে। এটি পঞ্চম জায়গা।  

সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, ইসরায়েলি বোমা হামলায় নিহত পরিবারের সদস্যদের সাদা কাফন পরানো অবস্থায় নিয়েই বাসিন্দারা পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ভারী বৃষ্টি ও তুমুল বাতাস দাফন প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে।  

আল জাজিরার সংবাদদাতা তারেক আবু আজুম দক্ষিণ গাজার আল মাওয়াসি থেকে জানান, বৃষ্টিপাত ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

তিনি বলেন, বিশেষ করে এটি তাদের জন্য উদ্বেগের, যারা তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর আদেশ অনুসরণ করে দক্ষিণে পালিয়ে গেছেন।

তিনি আরও বলেন, এখানকার লোকেরা নাটকীয় এবং ক্রমেই খারাপ হতে থাকা একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি। কারণ তারা কংক্রিটের বাড়ি থেকে তাঁবুসহ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে সব ধরনের মৌলিক চাহিদা পূরণের কোনো উপায় নেই।  

গাজায় ফিলিস্তিনিরা গাড়ি, ট্রাক, ঘোড়ায় টানা গাড়ি বা পায়ে হেঁটে দক্ষিণের দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন। রাফাহ এখন তাঁবুর সাগরে পরিণত হয়েছে। সেখানে কাঠ ও প্লাস্টিকের চাদরের বহু অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রও রয়েছে।  

জাতিসংঘ বলছে, দক্ষিণে পালানো বাসিন্দারা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি। সেখানে নিরাপদ পানি, খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তার স্বল্প সরবরাহ থাকায় বিতরণকেন্দ্রের আশেপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে লোকেরা। বাড়ছে রোগের প্রকোপও। বৃষ্টি আর বন্যায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।  

রাফাহ মিশরের সীমান্ত লাগোয়া শহর, উপত্যকাটির সর্বদক্ষিণের অংশ। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলা যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে দক্ষিণের দিকে যাওয়ার ফলে সেখানে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। এখন গাজার উত্তর ও দক্ষিণ কোথাও নিরাপদ নয়, দুদিকেই রয়েছে উত্তেজনা।  

কাঠ ও প্লাস্টিক শিট ব্যবহার করে রাফাহ শহরে শতাধিক তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে। বিলাল আল-কাসাস নামে বাস্তুচ্যুত এক ফিলিস্তিনি বলেন, আমরা বাইরে রাত কাটাচ্ছি গত পাঁচ দিন ধরে। এখন বৃষ্টিতে তাঁবু ভেসে গেছে।  

৪১ বছর বয়সী এ ব্যক্তি বলেন, আমরা কোথায় থাকব, আমাদের সম্ভ্রম চলে গেছে। নারীরা কোথায় গিয়ে স্বস্তি পাবেন? কোথাও কোনো বাথরুম নেই। আমরা শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছি। আমরা কিছু খেতে বা পান করতে চাই না।

জাতিসংঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএ বলছে, লোকজন খাবার, পানি, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা জরুরিভাবে প্রয়োজন।

এক বিবৃতিতে ওসিএইচএ বলছে, পর্যাপ্ত পায়খানার অভাব, খোলা স্থানে মলত্যাগের কারণে রোগ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে বৃষ্টির সময়ে।  

৩৮ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি নারী ইনাস। তিনি পাঁচ সন্তানের জননী। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তার পরিবার এ পর্যন্ত চারবার স্থান পরিবর্তন করেছে। উত্তর গাজায় তোয়াম অঞ্চল থেকে প্রথম তাদের সরতে হয়। প্রথমে তারা যান পার্শ্ববর্তী তাল আল-হাওয়ায়। পরে মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে এবং পরে খান ইউনিস এবং এরপর এখন রাফাহতে।  

তিনি বলেন, তার পরিবারের একটি পাঁচতলা বাড়ি ছিল এবং একটি সুপারমার্কেট ছিল, সবই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমি আশা করি যুদ্ধ শেষ হবে এবং ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী রাফাহ আক্রমণ করবে না। আমি মিশরে বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আতঙ্কিত।

তার কণ্ঠে গাজায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে থাকা সাধারণ ভয়ের চিত্রটিও উঠে এলো।  

গাজা ও ইসরায়েলের ঠিক দক্ষিণে মিশরের বিস্তীর্ণ মরুভূমি অঞ্চলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি আমাদের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন। তারা কি রাফাহ পর্যন্ত স্থলযুদ্ধ প্রসারিত করতে যাচ্ছে? এমন হলে আমরা কোথায় যাব? সমুদ্রের দিকে নাকি সিনাইয়ের দিকে? 

তিনি বলেন, বিশ্বের কাছে আমাদের আহ্বান, ইসরায়েলকে থামাও। আমরা গাজা ছাড়তে চাই না।  

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সিনাইয়ে ঠেলে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে মিশর বলেছে, তারা গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক আগমন চায় না।

গাজা-মিশর সীমান্ত বেষ্টনী এর আগে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এবার অনিয়ন্ত্রিত বাস্তুচ্যুতি ঘটে পারে, এমন শঙ্কা দেখা দিচ্ছে।  

৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় ১৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। আর আহত হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।  

ইসরায়েল বলছে, সেদিন হামাসের হামলায় তাদের ১ হাজার ১৪৭ জনের প্রাণ যায়। হামাস তাদের ২৪০ জনকে জিম্মিকে করে, যাদের প্রায় অর্ধেককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।