ভারত সরকার কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছে। আর রেলের এ প্রকল্প ঘিরে সেখানকার আপেল চাষিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
২০ বছর বয়সী মেহবিশ মুজাফ্ফর সেদিন এক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি।
তার গ্রাম রেশিপোরায় জরিপকারীরা এসেছেন। তারা ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেলপথ তৈরির জন্য আপেল বাগানের জমি চিহ্নিত করবেন। মেহবিশের কাছে এটি ছিল এক ভয়াবহ বার্তা। তিনি বলেন, খবরটা পড়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।
খবর শুনে মেহবিশের মা দিলশাদা বেগম গ্রামের অন্য নারীদের মতোই দৌড়ে চলে যান তাদের আপেল বাগানে। মেহবিশের পরিবার এ বাগানের ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
এ বাগান থেকে তাদের বার্ষিক আয় প্রায় ১৩ হাজার ইউরো বা ১২ লাখ রুপি। দিলশাদা বলেন, এ জমি আমাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি। এ বাগান আমাদের জীবন।
ভারত সরকারের রেল সম্প্রসারণ পরিকল্পনা মেহবিশের পরিবারের মতো অন্যান্যদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিলশাদা ও তার অসুস্থ স্বামী তাদের চার মেয়েকে এ বাগানের আয়ে বড় করেছেন। এমন আরও প্রায় ৩০০ পরিবার রয়েছে যাদের জীবিকা আপেল বাগানের ওপরই নির্ভরশীল।
৫৬ বছর বয়সী কৃষক মোহাম্মদ ইউসুফ রেশির কথায়, আপেল ছাড়া শোপিয়ান কল্পনাও করা যায় না। তিনি এতটাই হতাশ যে জমি কেড়ে নেওয়ার চেয়ে চাষিদের মৃত্যুকেও শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।
এসব বাগানগুলো শুধু রেশিপোরা গ্রাম নয়, বরং পুরো শোপিয়ান জেলার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকেরা জানান, জরিপকারীরা কোনো নোটিশ ছাড়াই জমিতে এসে কাজ শুরু করেন। তারা ড্রোন এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে বাগানের মাটি পরিমাপ করতে থাকেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ভারত সরকার কাশ্মীরে পাঁচটি নতুন রেললাইন স্থাপনের অনুমতি দেয়। এর মধ্যে একটি হলো আওয়ান্তিপোরা-শোপিয়ান লাইন। সমালোচকেরা বলছেন, প্রস্তাবিত পাঁচটি রেলপথ নির্মাণে প্রায় ২৮৮ হেক্টর জমি (৭১২ একর) লাগবে, যার বেশিরভাগই উর্বর জমি।
রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণ বলেছেন, এ রেলপথ শুধু যোগাযোগই বাড়াবে না, কাশ্মীরের পর্যটন ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও খুলে দেবে। উত্তর রেলের মুখপাত্র হিমাংশু শেখর বলেন, কিছু গাছ হয়তো কাটতে হবে, তবে আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আরও অনেক গাছ লাগানো হবে।
আশ্বাস কিংবা প্রতিশ্রুতি সেখানকার কৃষকদের জন্য কোনো সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করছে না। কেননা কাশ্মীরে বেকারত্বের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। সেখানকার আপেল চাষিদের কাছ থেকে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া মানে তাদের জীবিকার শেষ উপায়েরও ইতি টানা।
অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা তরুণ আজহার ওয়ানি বলেন, জমি গেলে চাকরি তো দূরের কথা, আমাদের টিকে থাকাই মুশকিল হবে।
গত এপ্রিলে রেশিপোরা গ্রামের কৃষকেরা বাগানে কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ করেন। তাদের ভাষায়, এ প্রকল্প তাদের ভবিষ্যৎকে কবর দেবে।
সরকারের এমন পরিকল্পনার বিপরীতে ওই অঞ্চলের কৃষকদের বিকল্প প্রস্তাব, অপেক্ষাকৃত কম উর্বর জমির ওপর দিয়ে রেললাইন নেওয়া হোক। কিন্তু সরকারের কথা হলো, কৃষকদের প্রস্তাবিত বিকল্প পথ অনেক দীর্ঘ।
কৃষক ইউসুফ রেশি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, প্রথমে আমাদের বলা হয়েছিল ৩০০ ফুট জমি লাগবে, পরে আবার ৯০০ ফুট জমির কথা বলা হয়। মনে হচ্ছে আমাদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে।
রেলপথ নির্মাণের এই পরিকল্পনার ফলে রেশিপোরা গ্রামের দৃশ্য এখন আর আগের মতো নেই। একদিকে আপেলের গাছে ফুল ফুটেছে, অন্যদিকে কৃষকদের চোখেমুখে উদ্বেগের ছায়া। তবুও কৃষকেরা লড়াই করার কথা বলছেন।
দিলশাদা বেগম তাদের বাগানে দাঁড়িয়ে বলেন, এ জমি শুধু মাটি নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব। এটি আমাদের ছেড়ে দিতে বললে আমরা লড়াই করব। আমাদের জীবন এখানেই। আমরা এটি হারাতে পারি না।
তবে সরকার আপাতত কোনোকিছুকেই পাত্তা দিতে না। রেলের মুখপাত্রের দাবি, রেলপথ শোপিয়ানের জন্য আশীর্বাদ হবে। তিনি কৃষকদের ক্ষোভকে যৌক্তিক মনে করলেও জমি অধিগ্রহণের পর চাকরির প্রতিশ্রুতি সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে বলে মনে করছেন।
পরিবেশবিদ রাজা মুজাফ্ফর এ পরিকল্পনাকে কেবল ধ্বংসের শুরু হিসেবে দেখছেন। তিনি বলছেন, প্রকল্পটি পরিবেশের ক্ষতি করবে এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার নীতি লঙ্ঘন করবে।
ডয়চে ভেলে অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০২৪
আরএইচ