রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতি আলোচনা করতে প্রস্তুত, তবে বড় কোনো এলাকা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নন। তাছাড়া যে কোনো চুক্তিতে কিয়েভের ন্যাটোতে যোগদানের অভিলাষও ত্যাগ করারও দাবি রাখবেন তিনি।
ক্রেমলিনের অন্তত পাঁচটি সূত্রের বরাতে রয়টার্স তাদের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি দ্রুত এই সংঘাত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; রাশিয়ান আধিপত্য বিস্তারের এই সময়টাতে আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরছেন। মস্কো এখন ইউক্রেনের একটি বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০২২ সাল যুদ্ধ শুরুর পর বর্তমানে রাশিয়া সবচেয়ে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে।
ট্রাম্পের দেওয়া কী ধরনের চুক্তি মেনে নেবেন পুতিন, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে গিয়ে পাঁচজন বর্তমান ও প্রাক্তন রুশ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ক্রেমলিন সম্ভবত যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় একমত হতে পারে, তবে তা শুধু ফ্রন্টলাইনগুলোতে (সম্মুখসীমা) সীমাবদ্ধ থাকবে।
তিনজন কর্মকর্তা বলেছেন, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া এবং খেরসন অঞ্চলের ‘সঠিক বিভাজন রেখা’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যদিও মস্কো এই চারটি অঞ্চলকে সম্পূর্ণ রাশিয়ার অংশ বলে দাবি করে, তবে তাদের বাহিনী এখানে বর্তমানে ৭০-৮০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। আর প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এখনও ইউক্রেনীয় সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাশিয়া খারকিভ ও মাইকোলাইভ অঞ্চলের ক্ষুদ্র কিছু এলাকা ত্যাগ করতেও রাজি হতে পারে, এমনটি জানিয়েছেন দুজন কর্মকর্তা।
এই মাসের শুরুতে পুতিন বলেছিলেন, যে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি অবশ্যই ‘ভৌত বাস্তবতা’ প্রতিফলিত করতে হবে। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তড়িঘড়ি যুদ্ধবিরতি পশ্চিমা দেশগুলোকে ইউক্রেনকে পুনরায় অস্ত্র সরবরাহের সুযোগ করে দেবে। যদি কোনো নিরপেক্ষতা (ন্যাটোর বিষয়ে ইউক্রেনের) না থাকে, তবে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে কোনো ভালো প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক কল্পনা করা কঠিন। কারণ এতে ইউক্রেন সবসময় ভুল হাতে ব্যবহৃত হবে, যা রাশিয়ান ফেডারেশনের স্বার্থের পরিপন্থি।
দুটি সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইউক্রেনকে আমেরিকান এটিএসএমএস মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার গভীরে আক্রমণ করার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত যেকোনো চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করতে পারে এবং যে কারণে মস্কোর দাবিগুলো আরও কঠোর হতে পারে। কারণ একপক্ষের রুশপন্থিরা ইউক্রেনের আরও বড় অংশ দাবি করছে।
ক’দিন আগে কিয়েভ প্রথমবারের মতো রাশিয়ান ভূখণ্ডে মিসাইল হামলা করেছে। মস্কোর দাবি এই হামলা সংঘাত বাড়াবে। সূত্র বলেছে, যদি কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি না হয়, তবে রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি বলেন, পুতিন ইতোমধ্যেই বলেছেন, সংঘাতটি ফ্রিজ (স্তিমিত) রাখার চেষ্টা কোনোভাবেই কার্যকর হবে না এবং মিসাইল হামলার অনুমোদন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত যা উত্তেজনা আরও বাড়াবে।
এই বিষয়ে ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর দেয়নি।
ট্রাম্পের যোগাযোগ কর্মমর্তা স্টিভেন চিয়াং রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি (ট্রাম্প) একমাত্র ব্যক্তি যিনি উভয় পক্ষকে একত্রিত করে শান্তি আলোচনা শুরু করতে ও যুদ্ধ শেষ করতে কাজ করতে পারেন এবং এই সংঘাত থামাতে পারেন।
১৯৮৭ সালের বই ‘ট্রাম্প: দি আর্ট অব দ্য ডিল’ এর লেখক ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, শান্তিচুক্তি প্রচেষ্টায় তিনি পুতিনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন। তবে এই চুক্তিতে তিনি কীভাবে দুই পক্ষকে রাজি করাবেন তা খোলাসা করেননি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তার দেশ ততক্ষণ ক্ষান্ত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ রুশ সেনাটি তাদের সীমা থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। এই সীমা বলতে তিনি ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে সীমানা ইউক্রেন অর্জন করেছিল তাকেই বুঝিয়ে ছিলেন। তবে শীর্ষ মার্কিন জেনারেলরা প্রকাশ্যে বলেছেন, এটি একটি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য।
গত ১৪ জুন অবিলম্বে যুদ্ধ অবসানের জন্য পুতিন যে প্রাথমিক শর্ত রেখেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল ইউক্রেনকে ন্যাটো যোগদানের অভিলাষ ত্যাগ করতে হবে এবং রাশিয়ার দখলে যাওয়া চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলের পুরো ভূখণ্ড থেকে সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
নিরাপত্তা গ্যারান্টি এবং সেনাবাহিনী ছোট করা
সূত্রগুলো বলেছে, রাশিয়া ইউক্রেনীয় মাটিতে ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতি সহ্য না করলেও, তারা কিয়েভের জন্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি থাকতে পারে। ক্রেমলিন সম্ভবত আরও কিছু দাবি করবে, যেমন কিয়েভকে তার সেনাবাহিনীর আকার সীমিত করতে হবে এবং রাশিয়ান ভাষার ব্যবহার সীমিত না করার অঙ্গীকার ইত্যাদি।
১৯৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত এবং আমেরিকার বিষয়ে রাশিয়ার অন্যতম বিশেষজ্ঞ ডিমিত্রি সিমেস রয়টার্সকে বলেন, একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি দ্রুত সম্পাদিত হতে পারে, যা যুদ্ধ শেষ করতে সাহায্য করবে। তবে স্থায়ী কোনো চুক্তি যা ইউক্রেন এবং রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগগুলোকে প্রশমিত করবে; অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে।
যুদ্ধে রাশিয়াই জয়ী হচ্ছে এটাই সত্য
বর্তমানে ইউক্রেনের ১৮ শতাংশ সীমানা নিয়ন্ত্রণ করছে রাশিয়া। যার মধ্যে ক্রিমিয়াও রয়েছে, যা ২০১৪ সালে নিজ ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল রাশিয়া। দনবাসের ৮০ শতাংশ (দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল) এবং জাপোরিঝিয়ার ৭০ শতাংশ এবং খেরসন অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ, খারকিভ অঞ্চলের প্রায় ৩ শতাংশ এবং মাইকোলাইভের একটি ছোট অংশও নিয়ন্ত্রণ করছে রুশ এবং তাদের সমর্থিত বাহিনী।
রাশিয়া ইউক্রেনের মোট ১ লাখ ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্যদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে প্রায় ৬৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
সূত্র আরও জানায় পুতিন নিজে থেকে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন, যেখানে রাশিয়া দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া এবং খেরসনের অধিকাংশ অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখবেন, যা এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয়ের বার্তা বহন করবে, একই সঙ্গে ইউক্রেনে রাশিয়ান ভাষাভাষী লোকদের সুরক্ষা করবে এবং ক্রিমিয়ার সঙ্গে স্থল সংযোগ সুরক্ষিত করবে।
সব রাশিয়ান কর্মকর্তাই বলেছেন, ক্রিমিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। ক্রেমলিনের শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনা সম্পর্কে অবগত এমন একজন শীর্ষ কর্মকর্ত রয়টার্স জানিয়েছেন, পশ্চিমকে কঠিন সত্য মেনে নিতে হবে যে, ইউক্রেনকে যে সমস্ত সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, তা যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে আটকাতে পারেনি।
একাধিক সূত্র রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে কেজিবির সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভ্লাদিমির পুতিন, যিনি ড্রেসডেনে অবস্থানকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন প্রত্যক্ষ করেছিলেন; সেই তিনি একটি ছোট বিশ্বাসযোগ্য পরামর্শদাতা গ্রুপের পরামর্শে নিজেই ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
এমএম/এমজেএফ