সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দামেস্কের দখল নিয়েছে। পালিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের মধ্য দিয়ে আসাদ পরিবারের অর্ধ শতাব্দীর শাসনের ইতি ঘটল। ব্যক্তিগত একটি উড়োজাহাজে দামেস্ক ছাড়েন বাশার আল-আসাদ। তিনি ২৪ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তবে তিনি কোথায় পালিয়েছেন, সেই তথ্য অজানা।
গৃহযুদ্ধে জড়ানো রাশিয়ায় বাশার-আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিযানের নেতৃত্বে ছিল ইসলামপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। গোষ্ঠীটির প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। তার নেতৃত্বে এইচটিএস শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
এইচটিএসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আল-জোলানি প্রায় এক দশক ধরে নিজেকে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। এর পরিবর্তে তিনি সিরিয়ায় একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র গঠনের ওপর মনোযোগ দেন।
২০১৬ সাল থেকে তিনি ও তার গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের এমন একটি সিরিয়ার দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে আসছেন, যা প্রেসিডেন্ট আসাদের শাসন থেকে মুক্ত। ২০১১ সালের আরব বসন্তে জনতার বিদ্রোহকে নৃশংসভাবে দমন করেছিলেন আসাদ, যা পরবর্তীতে একটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
২০১৭ সালে সিরীয় স্যালভেশন গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করে এইচটিএস। এর মাধ্যমে তারা ইদলিব প্রদেশ পরিচালনা করত। এই প্রশাসন বেসামরিক সেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিচারব্যবস্থা, এবং অবকাঠামো প্রদানের পাশাপাশি আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং সাহায্য বিতরণের দায়িত্ব নেয়।
তবে মানবাধিকারকর্মী, সংবাদ প্রতিবেদন এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, এইচটিএস কঠোরভাবে শাসন পরিচালনা করে এবং ভিন্নমত প্রকাশ সহ্য করে না। স্বাধীন সাংবাদিকতা সংগঠন সিরিয়া ডিরেক্টস প্রতিবেদনে জানায়, মানবাধিকারকর্মীদের নিখোঁজের পেছনে রয়েছে এইচটিএস। সেবা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ আনা বিরোধী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভকারীদের ওপর সরাসরি গুলি চালানোর অভিযোগও রয়েছে গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে।
১৯৮২ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে জন্ম নেন আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। তার পূর্ব নাম ছিল আহমেদ হুসেইন আল-শারা। তার বাবা সৌদি আরবে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৮৯ সালে তার পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে এবং দামেস্কের কাছেই জীবনযাপন শুরু করে।
২০০৩ সালে ইরাকে চলে যান আল-জোলানি। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অংশ হিসেবে তিনি ইরাকে আল-কায়েদায় যোগ দেন। এর আগে তার দামেস্কের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না।
ইরাকে ২০০৬ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন আল-জোলানি। পাঁচ বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। পরে তাকে সিরিয়ায় আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই গোষ্ঠী বিশেষ করে ইদলিবসহ বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে তাদের প্রভাব বিস্তার করে।
শুরুতে আল-জোলানি আল-কায়েদার ইসলামিক স্টেট ইন ইরাকের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে সমন্বয় করেছিলেন। এই সংগঠন পরে আইএসআইএল (আইএসআইএস) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
২০১৩ সালের এপ্রিলে আবু বকর আল-বাগদাদি হঠাৎই ঘোষণা দেন যে তার গোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে এবং তারা সিরিয়ায় তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করবে। পরে আল-নুসরা ফ্রন্টকে একীভূত করে আইএসআইএল (আইএসআইএস) নামে নতুন একটি গোষ্ঠী গঠন করে। তবে এই পরিবর্তন প্রত্যাখ্যান করেন আল-জোলানি। পাশাপাশি তিনি আল-কায়েদার প্রতি তার আওনুগত্য বজায় রাখেন।
২০১৪ সালে আল-জাজিরাকে প্রথমবারের মতো টিভি সাক্ষাৎকার দেন, যাতে তিনি বলেন, তার গোষ্ঠী ‘ইসলামিক আইনের’ যে ব্যাখ্যা দেবে, সিরিয়া সেই অনুযায়ী শাসিত হবে এবং খ্রিস্টান ও আলাভিদের মতো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর জন্য কোনো স্থান থাকবে না।
পরবর্তী কয়েক বছরে আল-জোলানি আল-কায়েদার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বৈশ্বিক খিলাফত প্রতিষ্ঠা প্রকল্প থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেন। এর পরিবর্তে তিনি সিরিয়ার সীমানার ভেতরে তার গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করার ওপর মনোযোগ দেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বিভক্তি তার গোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক লক্ষ্য নয়, বরং সিরিয়ার ভেতরে জাতীয় লক্ষ্যগুলোর ওপর মনোযোগ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা ছিল, যাতে ইদলিবের গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে আলেপ্পো বাশার আল-আসাদ সরকার দখল করে নিলে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইদলিবের দিকে যেতে শুরু করে। এটি শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। ওই সময়ে আল-জোলানি ঘোষণা দেন, তার গোষ্ঠীর নাম পরিবর্তন করে জাবহাত ফাতেহ আল-শাম রাখা হয়েছে।
২০১৭ সালের শুরুর দিকে হাজার হাজার যোদ্ধা আলেপ্পো থেকে পালিয়ে ইদলিবে আসে। এরপর আল-জোলানি তার গোষ্ঠীর সঙ্গে ওই গোষ্ঠীগুলোর কিছু অংশকে একত্রিত করে এইচটিএস (হায়াত তাহরির আল-শাম) গঠনের ঘোষণা দেন।
ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) মতে, এইচটিএসের ঘোষিত লক্ষ্যের মধ্যে ছিল, সিরিয়াকে আসাদের স্বৈরাচারী সরকার থেকে মুক্ত করা। আর ইতোমধ্যে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এ ছাড়া দেশ থেকে ইরানপন্থী যোদ্ধাদের বিতাড়িত করা এবং তাদের নিজেদের ব্যাখ্যা দেওয়া ইসলামী আইনভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাও তাদের লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগেও আসাদ বাহিনী দেশের উল্লেখযোগ্য অংশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। তাহলে এটি এত দ্রুত কীভাবে ভেঙে পড়ল? ২৭ নভেম্বর বিরোধী যোদ্ধাদের একটি জোট সরকারপন্থী বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করে।
তিন দিন পর বিরোধী যোদ্ধারা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখল করে। এরপর একের পর এক শহর দখল করে এবং এর ধারাবাহিকতায় রাজধানী দামেস্ক দখল করে নেয়। আর অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২৪
আরএইচ