ঢাকা, বুধবার, ৩ পৌষ ১৪৩১, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সিরিয়ার ‘ভবিষ্যৎ’ প্রশ্নে তুরস্ক কেন আলোচনায়

মিরকান মিশুক, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০২৪
সিরিয়ার ‘ভবিষ্যৎ’ প্রশ্নে তুরস্ক কেন আলোচনায়

বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। সঙ্গে পতন হয়েছে সিরিয়ার ওপর রাশিয়া এবং ইরানের প্রভাবের।

আসাদের পরিবার প্রায় পাঁচ দশক ধরে সিরিয়ার শাসন করেছিল। তার পতনে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতাবলয়ের ভারসাম্যেও বড় পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আসাদের পতনে এই মুহূর্তে যদিও অনেকেরই উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে, তবে পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ‘এমন সময়ে’ এই পরিবর্তন একটি ‘বিপজ্জনক শূন্যতা’ এবং আরও ‘সহিংসতা’ নিয়ে আসতে পারে। কারণ যখন প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক শক্তিগুলো হঠাৎ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তখন একটি বড় ঝুঁকির মুহূর্ত সৃষ্টি হয়।  

এই পতনের ফলে দেশটিতে ইরানের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়া ছিল ইরান ও হিজবুল্লাহর জন্য সংযোগ দেশ। এই মিত্র শক্তিগুলোর মধ্যে অস্ত্র সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হতো আসাদের সিরিয়া।  

ইসরায়েলের সঙ্গে এক বছরের যুদ্ধের পর হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ইয়েমেনের হুথিরাও বারবার বিমান হামলার শিকার হয়েছে। ইরান-সমর্থিত এই সমস্ত গোষ্ঠী এবং ইরাকের মিলিশিয়া ও গাজার হামাস মিলে ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ গঠন করেছিল, যা সিরিয়ায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গুরুতর সংকটের সম্মুখীন।

অন্যদিকে আসাদের পতন ইসরায়েলের জন্য সুখবর বটে, কারণ ইরানকে তারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের এই আক্রমণ তুরস্কের সাহায্য ছাড়া সম্ভব হতো না। সিরিয়ার কিছু বিদ্রোহীদের সমর্থন করে তুরস্ক। যদিও তারা হায়াত তাহরির আল-শামকে (এইচটিএস) সমর্থনের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে।  

তুরস্কে কমপক্ষে তিরিশ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী রয়েছেন, যা স্থানীয়ভাবে সংবেদনশীল একটি বিষয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোয়ান অনেক আগেই আসাদকে কূটনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় খুঁজতে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু আসাদ তা করতে অস্বীকৃতি জানান।

এই মুহূর্তে ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে তুরস্ককে সবচেয়ে বেশি সিরিয়ার বিষয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। এর মধ্যে সিরিয়ান শরণার্থী তো রয়েছেই। আরও রয়েছে, কুর্দি গোষ্ঠী– যাদের যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং সহায়তা দিয়েছে আইএসআইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য–যারা তুর্কি সীমান্ত বরাবর শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। আঙ্কারার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সিরিয়ার সমস্যা এখনো শেষ হয়নি। একদিন তাদেরই এর সমাধানে নামতে হবে।  

সফল পরিকল্পনা, সরঞ্জাম এবং সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে ব্যাপক আক্রমণ এবং ঐতিহাসিক বিজয়ের পর এইচটিএস-এর মতো একটি গোষ্ঠী যখন বিচ্ছিন্ন এবং আতঙ্কিত জাতিগোষ্ঠীগুলোকে নতুন সমাজের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলে, তখন বুঝতে হবে এর পেছনে দক্ষ কোনো নেতৃত্বের হাত রয়েছে।      

এরদোয়ান শুক্রবার(৬ডিসেম্বর) বলেছেন, তিনি আসাদের সঙ্গে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছিলেন, ব্যর্থ হয়েছেন। যার কারণে বিদ্রোহীদের অভিযানের সাফল্য কামনা করছিলেন। এটি হয়তো সরাসরি স্বীকারোক্তি নয়। তবে এই মুহূর্তে এরচেয়ে ‘স্পষ্ট’ বার্তার প্রয়োজনও বোধহয় নেই।

আল-কায়েদার মাধ্যমে গড়ে ওঠা এইচটিএস-এর একটি সহিংস অতীত রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সিরিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে সন্দেহ রয়েই গেছে।

তবে তুরস্ক কাকে সহায়তা করেছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এইচটিএস-এর শীর্ষ নেতৃত্ব আল-কায়েদা এবং আইএসের মতো অত্যন্ত চরমপন্থী দলের কাছে হাতেখড়ি নিয়েছে। যদিও এখন নিজেদের আরও পরিণত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। চরমপন্থীদের জন্য পরিবর্তন কঠিন, তবে কিছু ক্ষেত্রে হয়ত সম্ভব।

এই দাবানলের স্ফুলিঙ্গ হয়তো তুরস্কই সৃষ্টি করেছে, তবে আসাদের এত দ্রুত পতন হয়তো প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু কখনো কখনো খুব বেশি সাফল্যও বিপজ্জনক হতে পারে।

সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সিরিয়ায় ১৯৮০-এর দশকে বসবাস করা ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জন সাউরস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি নিজের চোখে আসাদ শাসনের দমননীতি দেখেছেন। বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকেও দেখেছেন।

তিনি বলেন, আমি যখন এমআই-সিক্স (ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা)-এর প্রধান ছিলাম, তখন আমরা সিরিয়ার সমস্ত বিরোধী গোষ্ঠীকে পর্যালোচনা করেছিলাম। তাদের মধ্যে কোনগুলোকে আমরা সমর্থন করতে পারি আর কোনগুলো আল-কায়েদার খুব ঘনিষ্ঠ এবং গ্রহণযোগ্য নয়, তা শ্রেণীবদ্ধ করেছিলাম। গ্রহণযোগ্যতার তালিকায় এইচটিএস একেবারে নিচের দিকেই ছিল।

বিশ্লেষণে তিনি বলেন, আসাদের শাসন কেবল দেশের ‘১৫% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’র প্রতিনিধিত্ব করত। এখন সিরিয়াকে একত্রিত করার জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ বিদ্রোহীদের সামনে অপেক্ষা করছে। আসাদের শাসনের ভয়ানক নির্যাতনের জন্য কিছু হিসাব-নিকাশ হবে। কিছু প্রতিশোধ তো হবে, তবে মোটাদাগে বিদ্রোহীরা কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চায় না।  

জন বলেন, হায়াত তাহরির আল-শাম আগে এমন একটি গোষ্ঠী ছিল যা আল-কায়েদার খুব ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি গত ১০ বছরে নিজেদের আল-কায়েদার প্রভাব থেকে দূরে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এইচটিএস-এর কার্যক্রমকে একটি স্বাধীনতাকামী আন্দোলন হিসেবে দেখা গেছে, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নয়।

তিনি বিশ্বাস করেন, ‘নতুন সিরিয়ায়’ তুরস্ক বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলিকে একত্রিত করে একটি একক, সুসংগঠিত নতুন শাসন ব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২৪
এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।