ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

জীবন এখানে এমন!

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৫
জীবন এখানে এমন! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিন্ধুপাল চক (নেপাল) থেকে: রাত ৯টা। সিন্ধুপাল চকের পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট গ্রাম ঢুসেনি, সুহারা টোলে।

এক তাঁবুতে আমিসহ ২০ জন মানুষের এ রাতটি কাটবে, যদি ভূমিকম্প, জঙ্গলের চিতা বা অন্য কোন প্রাণী মৃত্যুদূত হয়ে না এসে পড়ে।
 
এখানে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিজ্ঞতা হয়ে গেল পাহাড়ি ভূমিকম্পের। পাহাড়ি সবজি, ডাল ও আচার দিয়ে দুটা ভাত খাচ্ছিলাম, অমনি কেঁপে উঠল এতবড় পাহাড়টি। সামনে রাখা গ্লাসের পানি কাঁপছে।  
 
চুপচাপ রইলাম, যাতে সফরসঙ্গী ঢাকার কলিগটি (শিপন হাবিব, সংবাদকর্মী) ভয় না পান। কিন্তু তিনিই টের পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন।
 
খাওয়া শেষে আবার পাহাড়ের কাঁপন। মাধবের পুরো পরিবার আশ্বস্ত করতে শুরু করেন। জানালেন, এ ক’টি দিনে শতবারের উপরে এমন অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে।  

পাহাড়ি পথের লম্বা সফর, শরীরটা চুরচুর হচ্ছিল। খাওয়া শেষে তাই অদূরেই খোলা জায়গায় পাতা তাঁবুতে নিয়ে আসেন মাধবের মা। এ কষ্টের সময়ও সুন্দর চুড়ি, মালা, ঘড়ি পরণে তার। হাসিখুশি একটি পরিবার। প্রকৃতির যে কোন সিদ্ধান্তেই যেন মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা তাদের। তারা বোঝেন- এ পথে চলা শহুরে মানুষদের জন্য বেশ কষ্টের।
 
থামেল থেকে সিন্ধুপাল চক-পুরোটি পথ পাহাড় কেটে। শহরে যারা গাড়ি চালান তাদের জন্য নয় এ রাস্তা। এসেছি মোটরসাইকেলে। চালক মাধবপ্রসাদ আচার্য, থাকেন কাঠমান্ডুতেই। তার একটি ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে।
 
ঢুসেইনে অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে মাধবদের গ্রামের দুটি বাড়িই ভেঙে গেছে। পাহাড়ি এই পথে ১০/১২ বছর ধরে মোটরসাইকেলে যাতায়াত করছেন তিনি, ভালো চালক।

যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই মনে হল, এমন দুর্গম পথের সফর ডিসকভারি চ্যানেলের বেয়ার গ্রিলসকে ভালো মানায়। কারণ এখানে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।
 
রোদ, ধুলাবালিসহ পথের চড়াই-উৎরাই মোকাবেলায় মাস্ক, সুতির শার্ট, জিন্সের জ্যাকেট, মাথায় নরম কাপড়ের পাগড়ি, চোখে চশমা, পায়ে ফিতাওয়ালা মজবুত স্যান্ডেল আর ধুতি পরেছি। ঢাকায় মরে গেলেও এমন পোশাকে বের হবে না সুইটি। কিন্তু এখানে সুস্থ ও বেশি কর্মক্ষমতার জন্য ‘আমাকে কেমন দেখাবে!’র চিন্তা বাদ দিতেই হল।
 
পাহাড়ে সরু পথ, কখনো ভাঙা, কখনো পাহাড়ের পানিতে পিচ্ছিল। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে কয়েকশ’ ফুট নিচের পাথুরে নদী।
 
পাহাড়ের গায়ে যেভাবে পাথরগুলো ঝুলছে, একটি ছোট্ট ভূমিকম্পে এখানেই সমাধি হয়ে যাবে। কিংবা একবার মোটরসাইকেল হড়কে গেলে কয়েকশ’ ফুট নিচে পড়ে বেঘোরে প্রাণটা যাবে।
 
তবে নৈসর্গিক দৃশ্য যাতায়াতের কষ্ট অনেকখানি ভুলিয়ে দেবে। দূরে হিমালয় রেঞ্জ, অনেক অনেক পাহাড়, নদীটা দেখে মনে হবে একটি ছবি। স্থির ছবিতে পানিটাই শুধু প্রবাহমান।
 
দুপুর দেড়টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাহাড়ি পথে যতগুলো লোকালয় পেয়েছি, কোথাও অক্ষত নেই কোন বাড়ি-ঘর।
 
ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলোর বিষন্ন চোখ অন্তরটা নাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের চোখে তাকানোর জন্য অনেকটুকু মানসিক শক্তির প্রয়োজন হল এ ‘পাষাণ হৃদয়’ রিপোর্টারের।
 
কয়েকটি জায়গায় থামতে হল। মাস্ক খুলে ফেলি প্রায়ই মনের ভুলে। যদিও আসার আগে বাংলাদেশ বিমানের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইমরুল কায়েস ভাই বারবারই সাবধান করছিলেন।  
কারণ হিসেবে মাধব বললেন, সরকারি হিসেবের বাইরেও অনেক মানুষ মারা গেছেন সিন্ধুপাল চকে। দেহগুলো দাহ করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাই সিন্ধুপালের বাতাস এখন বিষাক্ত।
 
‘স্নো ভিউ মাউনটেইন রিসোর্ট’ সাইনবোর্ডের সামনে থেমে একটু বিস্কুট ও পানি খেলাম সবাই। ডানে গেলেই পর্যটনের ভালো জায়গা ‘নাগরকোট’। পাহাড়ের সূর্যোদয় দেখার আদর্শ জায়গা। তখনো জানি না, রাতের আগে আর খাওয়া হবে না।
 
ফটকশিলার শিপাঘাটের বাসিন্দা পদমলাল ডঙ্গাল। ভাঙা বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। বললেন, ভূচাল আয়া, নিকলা বাহার, ঝুরঝুর করকে মিটটি কা ঘর মিটটি মে (ভূমিকম্প এল, বাইরে এলাম, ওমনি মাটির ঘর মাটিতে। )
 
পদমলাল ও অন্য যে কয়জন ক্ষতিগ্রস্তের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের সবাই একটি কথাই বলছেন- সরকারের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।

দেখা হল বীর বাহাদুর নামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে। তাকে খাটিয়ায় গ্রামে নিয়ে আসছেন তার স্বজনরা। শহরে বিএনবি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ভূমিকম্পে আহত হয়ে।
 
ইন্দ্রাবতী নদীর ওপর ইন্দ্রাবতী ব্রিজ, তার পাশের ছোট্ট লোকালয়টি এখন মাটি ও পাথরের স্তুপ।
 
এর তিনতলা বাড়িটিতে জুয়েলারির দোকান ছিল রবীন্দ্র খাটিয়ার। এখন শুধুই স্মৃতি। ছোট্ট ছেলেটির হাত ভেঙেছে ভূমিকম্পে। তাকে কোলে নিয়ে ভাঙা দোকান-বাড়ির সামনে উদাস চোখে দেখছিলেন। স্ত্রী কুমারি খাতির কসমেটিক শপ ছিল, সেটিও নেই।
 
কষ্ট চেপে রবীন্দ্র বলেন, ‘উই আর রুইনড! সব কুছ খতম হো গ্যায়া! কুছ নেহী বাচা!’
 
সিন্ধু, তিন গাঁড়ে, ধোতারসহ সব গ্রামেরই এ চিত্র। প্রত্যেকেই অনেক কিছু হারিয়েছেন।  
এসব দেখতে দেখতে ঢুসেইনে এসেছি। বিদ্যুৎ নেই। সোলার সিস্টেমে দুটি বাতি জ্বালাচ্ছেন মাধবের পরিবার।
 
মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে ফোনের নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাড়তি একটি ফোন এনেছিলাম, সেটিই এখন কাজ দিচ্ছে।
 
ভাঙাবাড়িতে ঢোকা নিষেধ, যেকোন সময় ভেঙে মাথায় নামবে। তাই কোন আড়াল নেই, এক তাবুতে সবাই। ওয়াশরুমতো নেইই। হাজার প্রতিকূলতার দিকগুলো মাথা থেকে তাড়িয়ে তাঁবুতে বসে ইতিবাচক দিক খোঁজার চেষ্টা করছি।

শিপন হাবিব যাই দেখছেন, বিমোহিত হয়ে পড়ছেন, এমনিতেই তিনি অনেক আবেগপ্রবণ, সবার প্রতি তার অনেক মমতা।
 
আরও ভালো লাগছে- বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা পেয়েছি। পাহাড়ি ঝর্নার পানির পথে নল বসিয়ে লোকালয়ে আসার ব্যবস্থা করেছেন তারা, অত্যন্ত সুপেয় ও ঠাণ্ডা পানি। এখানে মানুষগুলো অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ।
 
মাধবের ভাই কৃষ্ণপ্রসাদ তিমল সিনা বলেন, ‘হামারি লিয়ে অতিথি দেব ভবা। আপ ইতনে দূর সে ইহা চালি আয়ে হামারা দুখ দেখনে কে লিয়ে, ইয়ে হামারি লিয়ে বহত হ্যায়। কোয়িতো ইহা নেহী আতে। সব শহরমে দুখ দেখনে যাতে হ্যায় (আমাদের জন্য মেহমান ভগবানের প্রতিনিধি। আপনি এত দূর থেকে এখানে চলে এসেছেন আমাদের দুঃখ দেখতে, কেউতো এখানে আসে না। সবাই শহরে যায় দুঃখ দেখতে’)।

সিন্ধুপাল চক
নেপালের ৭৫ জেলার অন্যতম সিন্ধুপালের অবস্থান দেশটির মধ্যাঞ্চলে। এর আয়তন ২ হাজার ৫৪২ বর্গ কিলোমিটার। জেলা সদর কতারায়। লোকসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর অন্যতম এই সিন্ধুপাল চক।

রাজধানী কাঠমান্ডুর কাছাকাছি হলেও সিন্ধুপালচকে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি তেমন। তবে পর্বতময় এ জেলার পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য।

পাহাড়ি মাটি খুব একটা উর্বর না হলেও কৃষিকাজই এ জেলার মানুষের প্রধান পেশা। এ জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ভোতে কোশি. ইন্দ্রবতী, সান কোশি ও ব্রহযানী  নদী।

ভোতে কশি ও সান কশি নদীতে নির্মিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত ন্যাশনাল গ্রিডের সঙ্গে।   আরো কিছু ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে এ জেলায়।

কাঠমান্ডু থেকে তিব্বতগামী কোদারি হাইওয়ের লিংকও আছে এ জেলার সঙ্গে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৫
এসকেএস/জেডএম

** বিধ্বস্ত নেপালে বাংলাদেশি সংবাদকর্মীরা
** শোকের ১৩ দিন, তবু জীবনের জয়গান
** নিস্তব্ধ পশুপতি, ভিড় কেবল চিতাঘাটে
** আড়ালেই ঝুরঝুরে নিম্বু-ভূতুড়ে ধর্মস্থালী
** দরবার স্কয়ার এখন তাবুর স্কয়ার
** বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই নাকে লাশের গন্ধ
** সাজেদা সুইটি এখন কাঠমান্ডুতে
** বিপন্ন নেপালে যাচ্ছেন সাজেদা সুইটি
** বিমানের কাঠমান্ডু ফ্লাইট বিলম্বিত

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।