ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ‘মুসলিম বিদ্বেষীরা’, ইসলামি বিশ্বে আতঙ্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৬
ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ‘মুসলিম বিদ্বেষীরা’, ইসলামি বিশ্বে আতঙ্ক মাইক পোম্পেও, মাইকেল টি ফ্লিন ও জেফ সেসন্স

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে ভয়-আতঙ্ক বুঝি সত্যি হতে চলেছে! প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম বিদ্বেষী নানা বক্তব্যের মধ্যে মসজিদে মসজিদে নজরদারি এবং মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ পর্যন্ত বন্ধ করে দেবেন বলে তিনি যে হুংকার-ধমক ছেড়েছিলেন, তা-ই যেন বাস্তবে করতে চলেছেন।

ঢাকা: ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে ভয়-আতঙ্ক বুঝি সত্যি হতে চলেছে! প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম বিদ্বেষী নানা বক্তব্যের মধ্যে মসজিদে মসজিদে নজরদারি এবং মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ পর্যন্ত বন্ধ করে দেবেন বলে তিনি যে হুংকার-ধমক ছেড়েছিলেন, তা-ই যেন বাস্তবে করতে চলেছেন।

এখন পর্যন্ত ট্রাম্প তার সরকারের প্রশাসনে প্রধান যে ক’জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে এমন এমন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যারা কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী বলে বিভিন্ন সময়ে বদনাম কামিয়েছেন।

বিশেষত অ্যাটর্নি জেনারেল, সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র পরিচালক ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে ট্রাম্প যে তিনজনকে নিয়োগ দিয়েছেন, তারা তাদের বক্তৃতায়-বইয়ে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী বিতর্কিত মন্তব্য করে বা অবস্থান জানিয়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন, হয়েছেন নিন্দিতও।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হয়ে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে উঠছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইকেল টি ফ্লিন। আর অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সিনেটর জেফ সেসন্স এবং সিআইএ পরিচালক হিসেবে মাইক পোম্পেও উঠছেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ‘প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে’।

এ তিনজন কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী বলে কেবল ইসলামি বিশ্বে নয়, খোদ আমেরিকাতেও পরিচিত, এমনকি তাদের সাবেক সহকর্মীরাও তিনজনকে গোঁড়া ধর্মবিদ্বেষী বলেই জানেন।

এদের ইসলাম বিদ্বেষের নমুনাটা এমন; প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) সাবেক প্রধান ফ্লিন একবার ইসলামকে বলেছিলেন ‘ক্যান্সার’। তার সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক আরেকটি মন্তব্য ছিল ‘মুসলিম ভীতি যৌক্তিক’। তিনি আরও বলেছিলেন, ইসলাম হচ্ছে ধর্মের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক আদর্শ। সম্প্রতিই তিনি ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার পর একটি ‘অ্যাক্ট ফর আমেরিকা’ নামে একটি কট্টর সংগঠনের পরিচালক বোর্ডে যোগ দেন। এই সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের দুই ডজনেরও বেশি রাজ্যে ইসলামি বিধি-বিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিল উত্থাপনে কাজ করছে।

আর ট্রাম্প যে তার প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম অভিবাসী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছিলেন তাতে গলা উঁচিয়ে সমর্থন দিয়েছিলেন সেসন্স। তিনি একবার বলেও ছিলেন,  ‘ইসলামের শেকড়ই একটা বিষাক্ত আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত’। সিরিয়ার শরণার্থীরা সংকটে পড়লে তাদের আশ্রয় দিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন এগিয়ে আসতে চাইলে তার কড়া সমালোচনা করেন সেসন্স। তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের আচার-সংস্কৃতি থেকে দূরে তাদের অগ্রাহ্য করা দোষের কিছু নয়। তাছাড়া কে কোথায় কীভাবে হুমকি হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের ব্যবহার করতে হবে-এটা তো ইসলামেরই বিষাক্ত আদর্শ। ’

পোম্পেও পরিচিত হয়েছেন মিশরের উগ্রবাদী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করতে উত্থাপিত বিলের সহ-প্রস্তাবক হয়ে। এই প্রস্তাব তাকে পরিচিত করলেও ২০১৩ সালের বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলার আগে প্রকাশ্যে তেমন ধর্মদ্বেষী কথা বলতেন না। কিন্তু ওই হামলার পর পোম্পেও মুসলিম নেতাদের অভিযুক্ত করে বলেন, ‘উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে না পেরে তারা নিজেরাই এ ধরনের ঘটনায় জড়িত বলে শঙ্কার ভিত্তি দিয়েছেন। ’ তার কথার জের ধরেই ট্রাম্প নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছিলেন, আমেরিকান মুসলিমরা জানে তাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কে!

এমন আবোল-তাবোল কথক আর উগ্র মানসিকতার এ তিনজনকে এতো বড় বড় পদে নিয়োগে যে কেবল মুসলিমদেরই উদ্বেগের কারণ আছে, তা মনে করছে না আমেরিকান সংবাদমাধ্যম। তারা বলছে, এই সাম্প্রদায়িক ও কট্টর মানসিকতার ব্যক্তিদের এতো দায়িত্বশীল জায়গায় নিয়োগে মুসলিম আমেরিকান জনপদ এবং মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি চিন্তার ভাঁজ পড়ছে উদার আমেরিকানদের কপালেও। সাবেক কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রকাশে-অপ্রকাশ্যে বলে চলেছেন, হোয়াইট হাউসে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকদের ভেড়ানোর কারণে বিশ্বব্যাপী এই বার্তা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। খোলাসা করে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে এই কর্মকর্তাদের দেখিয়েই বলার সুযোগ থাকবে যে হোয়াইট হাউস ইসলাম বিদ্বেষী, যেটা পরিস্থিতিকে কেবল ঘোলাই করবে।

আমেরিকার নাগরিক অধিকার সংগঠন ও বিশ্বাসবাদী সংগঠনগুলোর নেতাদের বক্তব্যেও প্রকাশ পায় এই নিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) আমেরিকাজুড়ে কয়েকটি অনুষ্ঠানে অধিকার ও বিশ্বাসবাদী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, ট্রাম্পের এ ধরনের নিয়োগে তারা বিরক্ত।

যুক্তরাষ্ট্রে জর্দানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে একটি চিন্তাবিদ সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মারওয়ান মুয়াশের যেমন বলেন, এই তিনজন (ফ্লিন, সেসন্স ও পোম্পেও) ভালোই পরিচিত মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কড়া মানসিকতা পোষণ করেন বলেই নানা সময়ে প্রকাশ পেয়েছে- তাদের দায়িত্ব দেওয়ায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক লড়াইকে জটিল করে তুলতে পারে।

তিনি বলেন, যখন আঞ্চলিক শক্তিগুলো মিলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন পুরো মুসলিম বিশ্বকে একই কাতারে না ফেলে ইসলাম ও মুসলিমদের আলাদাভাবে দেখার জন্য একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। কিন্তু এরা (তিন কর্মকর্তা) বিষয়টিকে কখনোই আলাদা করতে পারেননি।

মুয়াশের স্পষ্ট করে বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা পাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন প্রশাসন পুরো মুসলিম বিশ্বের বদলে একটি অংশকে সমস্যা বলে চিহ্নিত করে এবং সেজন্য সমাধান বের করে।

ওয়াশিংটনের প্রাচীন ও প্রখ্যাত ‘মসজিদ মুহাম্মদ’র প্রেসিডেন্ট ও ইমাম এবং মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা তালিব এম শরিফ বলেন, সব আমেরিকানেরই এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। এই নিয়োগে আমেরিকার বন্ধুরা দূরে সরে যাবে, সশস্ত্র বাহিনী ও সরকারের মধ্যে থাকা আমেরিকান মুসলিমরাও নিজেদের পর ভাবতে শুরু করবে।

শরিফের পাঁচ সন্তানও মার্কিন সামরিক বাহিনীতে কর্মরত। তিনি বলেন, আগে প্রশাসন অনেক উদার হওয়া সত্ত্বেও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে সন্তানদের, যার ফলে তাদের স্বাভাবিক তৎপরতা ব্যাহত হয়েছে। এখন এরমধ্যে যদি মানসিক অস্থিরতার কিছু ঘটে তবে কী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

চিন্তাবিদ সংগঠন সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টারের প্রেসিডেন্ট রিকার্ড কোহেন বলেন, বিপদের কথা হলো তারা (তিন কর্মকর্তা) মুসলিম অভিবাসীদের নিয়ে যদি কোনো আইন প্রণয়ন করেন, সেটা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম বন্ধুদেরই দূরে সরিয়ে দেবে না, আমেরিকান মুসলিমদেরও আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। একইসঙ্গে আমাদের শত্রুতেও পরিণত করতে পারে তাদের।

এই অধিকার বা বিশ্বাসবাদী সংগঠনের নেতাদের উদ্বেগটা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, উদ্বেগ আরও বাড়ছে এ নিয়ে যে, ট্রাম্প শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন ধর্ম বিদ্বেষীদের নিয়োগ দিয়েছেন, ভবিষ্যতে তাহলে তার সরকারের কাঠামো ও কর্মসূচি কী হবে এবং তার মন্ত্রিসভায়, বিশেষত পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তথা পেন্টাগনের দায়িত্বেইবা তিনি কাদের নিয়োগ দেবেন?

কিন্তু এই সত্যিকারের উদ্বেগ যে ধনকুবের থেকে প্রেসিডেন্ট বনে যাওয়া ট্রাম্প কানে তুলছেন না তা ফ্লিন, সেসন্স ও পোম্পেওর পরপর নিয়োগেই স্পষ্ট।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৬/আপডেট ০০৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।