‘য পলায়তি স জীবতি’---যে পালায় সে বাঁচে। কিন্তু কী করে পালাবে? কোথায় পালাবে? কড়াই থেকে আগুনে, বাঘের মুখ থেকে হায়েনার গ্রাসে?
পালাবার পথ নেই কোনো।
তাদের লক্ষ্যবস্তু হলো ঘাপটি মেরে থাকা আইসিস, আল কায়েদা ও আল নুসরা বাহিনী ‘খুনে দজ্জালরা’। কিন্তু শিশুরা ও নারীরা, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের অপরাধটা কি? তাদেরকেও শত্রুশিবিরের লোক গণ্য করে চলছে নির্বিচার হামলা। নাকি আসাদ-পুতিনের দৃষ্টিতে এদের মৃত্যু ‘কো-লেটারাল ডেথ’?
গত ৫ বছর ধরে চলছে এই হনন-উৎসব। বিদ্রোহীরাও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। আর তাতে করে সাধারণ মানুষ আরো বেশি বিপন্ন। কে বিদ্রোহী আর কে নিরীহ মানুষ আলাদা করার উপায় আর নেই। অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ আকার নিয়েছে গত ৯ দিন আগে সিরীয় ও রুশ বিমানের অবিরাম হামলা শুরুর পর। এই কয়দিনে তা এক ঘণ্টার জন্যও থামেনি। এমনকি জাতিসংঘের সর্বসম্মত অস্ত্রবিরতি নামের প্রহসনের পরও।
ঘৌতায় বিমান ও রকেট হামলায় এ পর্যন্ত ঝরেছে প্রায় ৬০০ মানুষের প্রাণ। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো এর দেড়-দুইগুণ। আহত ও পঙ্গু হয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজারের মতো। এই হতাহতদের একটা বড় অংশ নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পঙ্গু, অন্ধ নিরীহ মানুষ। পুরো ঘৌতা ছিটমহলই এখন বিমান, কামান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এক বাছবিচারহীন লক্ষ্যবস্তু। এটা কোনো জনপদ নয় যেন; এ যেন এক ক্রমশ-সীমানা-বাড়তে-থাকা এক বিস্তৃত কবর।
রাশিয়ার জেদের মুখে ব্যাপক সংযোজন বিয়োজন শেষে সব পক্ষের সম্মতির মধ্য দিয়ে শনিবার ঘৌতায় ৩০ দিনের অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘে। কিন্তু হামলা তাতে থামেনি একরত্তি। বোমা ফেলা থামেনি। জঙ্গি ও বোমারু বিমানের অতর্কিত মৃত্যু-পরোয়ানা থামেনি। কামান গর্জনে ছেদ পড়েনি। হামলা, সাইরেনের শব্দ, আর্তরোল, আগুন আর ধোঁয়ার নরক গুলজার চলছে সমানে।
বৃহৎ শক্তিগুলোর কূটনীতির কূটচালও চলছে সমানে। যুক্তরাষ্ট্র, তার পশ্চিমা ও আরব মিত্ররা একদিকে; আর অন্যদিকে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া, সিরিয়া, ইরান, হিজবুল্লার ‘ক্ষান্ত না দেবার পলিসি’। এভাবে ঘৌতা হয়ে উঠেছে আমেরিকা-রাশিয়া নামের দুই আধুনিক কৌরব-পাণ্ডব শিবিরের কুরুক্ষেত্র। এ নিয়ে লড়াইটাও 'মর্যাদার লড়াই' নামে হয়ে উঠেছে এক ছলনার অন্তহীন পাশাখেলা। ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে...’।
কিন্তু এই নোংরা, নিষ্ঠুর রণচাতুর্যের, এই অন্তহীন ক্রূরতার, এই অশেষ হিংসার বলি হচ্ছে কোলের শিশুটি, গর্ভবতী অসহায় নারীটি, অক্ষম বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাটি। যারা কাউকে মারেনি বা মারবে না। তবু তাদের মরতে হচ্ছে---কারণহীন। খাদ্যহীন, ওষুধহীন, পানিহীন, নিত্যপণ্যহীন এক মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের বিনা দোষে। তাদের সামনে-পেছনে মৃত্যু আর মৃত্যু; আগুন আর অন্ধকার।
আল কায়েদা, আইসিস ও আল নুসরা ফ্রন্ট-এর মতো সবচেয়ে বিপজ্জনক জঙ্গি দলগুলো এবং রাশিয়ার চোখে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত ব্যক্তিরাও অস্ত্রবিরতিতে কোনো ছাড় পাবে না। এদের বিরুদ্ধে অভিযান আগের মতোই চলবে।
আর আল কায়েদা, আইসিস ও আল নুসরা ফ্রন্টও বেপরোয়া। ‘টিল্ উই ডাই’ বলে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চায় ওরা। তা-ও আবার সাধারণ মানুষের দলে মিশে গিয়ে।
স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেস ঘৌতাকে ‘দুনিয়ার বুকে নরক’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু জাতিসংঘ নামের ‘ ঠুঁটো জগন্নাথ’ কথার ফুলঝুরি আর কথার খই ফোটাবার বাইরে কিছুই করতে পারবে না। জাতিসংঘের কথায় গাছের একটি পাতাও নড়বে না। একটি বোমা হামলাও কমাবেন না পুতিন বা আসাদ।
সর্বশেষ সোমবার বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ঘৌতা এলাকায় রাসায়নিক গ্যাস-হামলার খবর দিয়েছে। বহু নারীশিশু ও অসহায় বেসামরিক মানুষ তাতে আক্রান্ত। হাসপাতাল স্কুল, উপাসনালয় এমনকি ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থল বা বেজমেন্টে বসেও রাসায়নিক গ্যাস হামলা থেকে বাঁচা অসম্ভব। আহাজারি আর বুকফাটা কান্নায় ভরে উঠেছে ঘৌতার আকাশ-বাতাস।
গোটা দুনিয়া দেখছে কিন্তু দুনিয়াবাসী নীরব দর্শক। ট্রাম্প-পুতিনের শুভবুদ্ধির উদয় না হওয়া পর্যন্ত রেহাই মিলবে না। তারা দাবার ঘুঁটি চালছেন। রিয়েল পলিটিকের এই হীন পাশাখেলায় তাদের জিততেই হবে। এর মানে, মানুষ মরছে মানুষ আরো মরবে মানুষ মরতেই থাকবে ...ঘৌতা নামের দুনিয়ার সর্বশেষ হাবিয়া দোজখে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৮
জেএম