রীতিমতো সময় বেঁধে দিয়ে কোনো ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো উত্তর কোরীয় নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসার আগ্রহের কথা জানানোটা বিস্ময়করই বটে। ঘটনার অজানা কোনো আকস্মিকতায়, নাকি চমক সৃষ্টির বাতিক থেকে ট্রাম্প এমন ঘোষণা দিয়ে বসলেন, এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে।
এরই মধ্যেই হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র স্যারাহ স্যান্ডার্স নেতিবাচক ইঙ্গিতই দিলেন শুক্রবার। তিনি শর্ত জুড়ে দিয়ে ঘোষিত বৈঠকটি না হবার সম্ভাবনার কথাই বললেন: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরীয় নেতার সঙ্গে বসবেন না, যদি না উত্তর কোরিয়া ‘‘সুনির্দিষ্ট কিছু করে দেখায়’’।
অসংখ্য ‘যদি’ ও ‘তবে’-র বাধা পেরিয়ে বৈঠকটি যদি শেষ পর্যন্ত হয়েই যায়, তাহলে সেটি হবে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ঘটনা।
আর এমন একটি বৈঠক অনুষ্ঠান হবে ‘অসম্ভবকে সম্ভব করা’র চূড়ান্ত নজির। কেননা এর আগে কখনোই কোনো ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা দূরে থাক, কোনো মাঝারি নেতার সঙ্গেও কোনো বৈঠকে মিলিত হননি। তাই এমন একটি বৈঠক মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্লেষকদের চোখে ‘ভেঞ্চার ইন টু আনচারডেট ওয়াটার’ বা ‘অচেনা জলে নামা’র মতো ব্যাপার।
এবার আসা যাক ইতিবাচক সম্ভাবনার দিকে। অর্থাৎ ধরে নেয়া যাক বৈঠকটি হবেই। এখন প্রশ্ন হলো, কোথায় হবে সেটি? ট্রাম্প-কিমের মধ্যে অভূতপূর্ব, ঐতিহাসিক, কল্পনাতীত বৈঠকটির উপযুক্ত ভেন্যুইবা কোনটি হবে? দু’পক্ষই কি কোনো একটি ভেন্যুকে উপযুক্ত বলে মনে করবে?
ওয়াশিংটন আর পিয়ং ইয়ং--এ দুয়ের অবস্থান অনেকটা ‘‘আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বায়ে...’’—এর মতো। বা তারও চেয়েও বিপরীতগামী এই দুই ‘জানি-দুষমন’ দেশের অবস্থান।
এরই মধ্যে বেশ কিছু দেশ ট্রাম্প-কিম ঐতিহাসিক বৈঠকের আয়োজক হবার সুযোগ লাভের জন্য চেষ্টা-তদ্বির শুরু করে দিয়েছে। মে মাসে শেষ দিকে যদি প্রস্তাবিত বৈঠকটি আদৌ হয়, সেক্ষেত্রে হাতে এখনো সময় আছে ১২ সপ্তাহ।
মার্কিন প্ল্যানারদের সামনে সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে বৈঠকের ভেন্যু ঠিক করা। ট্রাম্পের মতো রিয়েল এস্টেট টাইকুনের একথা ভালোই জানা থাকবার কথা যে, আলোচনার জন্য ভেন্যুটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা তাই যথার্থই লিখেছে: The Big Unknown In A Trump-Kim Meeting? Location, Location, Location.
এরই মধ্যে সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড ---পশ্চিমা এই দুই দেশ বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। অন্য দিকে মধ্য এশীয় দেশ মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সাখিয়াগিন এলবেগদোরি (Tsakhiagiin Elbegdorj) মনে করেন, তার দেশই হচ্ছে এমন একটি ঐতিহাসিক মহাযজ্ঞের সর্বোত্তম স্থান। তার ভাষায়, মঙ্গোলিয়া হচ্ছে ‘সবচেয়ে উপযুক্ত’ এবং ‘সবচেয়ে নিরপেক্ষ’ স্থান। কেননা, দুনিয়ার কারো সাতে-পাঁচে নেই মঙ্গোলিয়া।
উত্তর কোরীয় নেতার শৈশব-কৈশোরের একটা অংশ সুইজারল্যান্ডে কেটেছে। কিন্তু ২০১২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর একটিবারও তিনি দেশের বাইরে পা রাখেননি।
উত্তর কোরিয়া?
এর আগে উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত সব হাই প্রোফাইল বৈঠক হযেছে উত্তর কোরিয়ার মাটিতেই। সাবেক হওয়া দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও বিল ক্লিনটন দুজনেই উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে বৈঠক করেছেন। এরারও কি তাই হবে?
যুক্তরাষ্ট্র?
নাকি যুক্তরাষ্ট্রেই হবে এ বহুল প্রত্যাশিত বৈঠক? ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি উত্তর কোরীয় নেতা কিমকে যুক্তরাষ্ট্রে বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন এবং তাকে হামবার্গার দিয়ে আপ্যায়ন করবেন।
চীন, রাশিয়া নাকি দক্ষিণ কোরিয়া?
সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে আরও যে কয়েকটি রাষ্ট্রের কথা মাথায় আসে সেগুলো হচ্ছে, চীন, রাশিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়া।
নাকি দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী অসামরিক স্থান বা ডিএমজি?
কোনো রাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ভেন্যুতে দুই দেশ যদি বসতে একমত না হয়, তাহলে ভেন্যুর জন্য একটা স্থানই অবশিষ্ট থাকে। আর তা হচ্ছে, দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী অসামরিক স্থান বা ডিএমজি। অনেকের দৃষ্টিতে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে যৌক্তিক চয়েস। অর্থাৎ ‘‘শান্তির গ্রাম’’ পানমুনজম। এখানেই আগামী মাসে হতে যাচ্ছে গত কয়েক দশেকের মধ্যে প্রথম আন্ত:কোরীয় সামিট। তাহলে ট্রাম্প-কিম বৈঠকটি সেখানে হতে বাধা কোথায়?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুই যুযুধান বৈরী রাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা হাজারো দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বাধা, মতবিরোধ পাড়ি দেবেন কিভাবে, ‘যদি’ ও ‘তবে’র সংখ্যাহীন কন্টক সরিয়ে? কোন জাদুবলে রাতারাতি সমঝোতার মসৃণ ভূমিতে এসে পরস্পর হাত মেলাতে পারবেন তারা?
দেখা যাক, নয় মণ ঘি জোগাড় হয় কিনা, আর সোহাগ-চাঁদবদনী রাধা নাচতে নামেন কিনা!
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৮
জেএম