ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাপকা বেটা: লাদেন-হামজার অভিন্ন পরিণতি!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০১৯
বাপকা বেটা: লাদেন-হামজার অভিন্ন পরিণতি! বাবা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে শিশু বয়সে হামজা। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ‘প্রিয় বাবা, খুব ছোটবেলায় আপনার কাছ থেকে আমাকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। এখনো ১৩ (বছর) হয়নি। তারপরও, আমি বড় হয়েছি আর পুরুষ হয়ে গেছি। কিন্তু, যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি দুঃখ দেয়, তা হলো- মুজাহিদীন সৈন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ, আমি এখনো তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারিনি।’

আবেগ আর ক্ষোভে ভরা কথাগুলো কোনো সাধারণ ব্যক্তির নয়। একসময় গোটা বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টি করা সশস্ত্র গোষ্ঠি আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের এক শিশু-পুত্রের কথা এগুলো।

২০০৯ সালে বাবাকে দেওয়া এক চিঠিতে এভাবেই মনের কথা জানিয়েছিলেন হামজা বিন লাদেন। অর্থাৎ, শিশু বয়সেই বাবার চরিত্রের ছায়া পড়েছিল তার মধ্যেও।

সম্প্রতি লাদেনের এ পুত্র মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে, কবে-কীভাবে-কাদের হামলায় হামজা নিহত হয়েছেন তা পরিষ্কার করেনি পেন্টাগন। ধারণা করা হচ্ছে, মাত্র ৩০ বছর বয়সেই প্রাণ হারিয়েছেন হামজা বিন লাদেন।

যদিও, লাদেন-পুত্র মারা যাওয়ার খবর এটাই প্রথম নয়। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার সময় হামজাও প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা। বছর দুয়েক আগেও তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছিল। তবে, এ বিষয়ে আল-কায়েদার পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি।

মৃত্যুর খবরের মতো হামজা বিন লাদেনের জীবনও রহস্যময়। পিতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর কিশোর বয়সে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হামজাই হয়ে উঠেছিলেন আল কায়েদার মুখপাত্র। সশস্ত্র গোষ্ঠির সদস্যদের চোখে এ তরুণ ছিল ‘আদর্শ বয়ে নেওয়া এক সিংহশাবক’।

হামজার খোঁজ দিলে ১০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল স্টেট ডিপার্টমেন্ট।  ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিলের এক গোপন অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। ওই আস্তানায় পাওয়া নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২৩ ভাই-বোনের মধ্যে হামজা ছিলেন বাবার সবচেয়ে প্রিয়। আল কায়েদার ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে তাকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। ছোটবেলা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে বাবার সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যোগ দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন হামজা।  

২০১৪ সালে অবশেষে তার সে স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেয়। ওই সময় লাদেনের উত্তরসূরী আয়মান আল-জওয়াহিরি হামজাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আল কায়েদার সদস্য ঘোষণা করেন। দলের নেতাদের বিশ্বাস ছিল, বিখ্যাত বাবার সন্তান হিসেবে তিনি সহজেই আইএসের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠির অনুসারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন।

আগে থেকেই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে উন্মুখ ছিলেন হামজা বিন লাদেন। আল কায়েদায় যোগ দিয়েই তিনি পশ্চিমা শহরগুলোতে হামলার ঘোষণা দেন। এছাড়া, আমেরিকানরা নিজ দেশে তো বটেই, বাইরের দেশেও হামলার শিকার হবেন বলে হুমকি দেন লাদেন-পুত্র।  

২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিক অডিওবার্তায় সৌদি রাজতন্ত্রের পতন ও ফিলিস্তিন স্বাধীন করতে সিরীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলোকে এক হওয়ার আহ্বান জানান হামজা।

এছাড়া, ওবামা প্রশাসনের ‘ফাঁকা বুলি’তে ভয় পান না উল্লেখ করে তাদের কঠোর সমালোচনা করেন লাদেনের ছেলে। এক বার্তায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ারও প্রতিজ্ঞা করেন তিনি।  

 ২০০১ সালে সশস্ত্র আল কায়েদা নেতাদের সঙ্গে শিশু হামজা।  ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালে ওসামা বিন লাদেনের কাছে লেখা এক অনুসারীর চিঠি থেকে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই আল কায়েদা সদস্যদের কাছে হামজা বেশ জনপ্রিয় ছিল।

চিঠিতে ওই লাদেন-অনুসারী লিখেছেন, সে (হামজা) আমার কাছে এসে বললো, তারও প্রশিক্ষণ ও বিসর্জনে অংশ নেওয়া দরকার। সে ‘কারও’ ছেলে হওয়ার কারণে বিশেষ সুবিধা নিতে চায় না। আমি তাকে বন্দুকসহ বিভিন্ন অস্ত্রের বিষয়ে নিরাপদ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওয়াদা করেছি।

হামজা বিন লাদেন বিয়ে করেন আল কায়েদার জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল্লাহ আহমেদ আব্দুল্লাহর এক মেয়েকে। যে আস্তানায় লাদেন নিহত হন, সেখানে তাদের বিয়ের ভিডিও পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া, তার পরিবারের সদস্যরা জানান, ৯/১১ হামলার পরিকল্পনাকারী মোহাম্মদ আতার মেয়ের সঙ্গেও বিয়ে হয়েছিল হামজার।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আল কায়েদা প্রকাশিত এক চিঠিতে হামজা বিন লাদেন জানান, তার ১২ বছর বয়সী ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। তবে, কবে-কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে, তা জানানো হয়নি।  

ওই বছরই হামজাকে ‘বিশ্ব সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। তার খোঁজ দিতে পারলে ১০ লাখ ডলার পুরস্কারও ঘোষণা করে স্টেট ডিপার্টমেন্ট। সৌদি আরব তার নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেয়। চলতি বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও তাকে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে। তবে, এসব ঘোষণার সময় হামজা বিন লাদেন জীবিত ছিলেন কি-না, না নিশ্চিত করে বলতে পারেনি কেউই।

সিআইএ’র ধারণা, হামজার বিয়ের ছবি এটি।  ছবি: সংগৃহীত

ধারণা করা হয়, ১৯৮৯ সালের ৯ মে সৌদি আরবের জেদ্দায় জন্মগ্রহণ করেন হামজা ওসামা মুহাম্মদ বিন লাদেন। যদিও, স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, তার জন্ম ১৯৮৬ সালে। হামজার মায়ের নাম খাইরিয়া সাবার। বেঁচে যাওয়া তিন লাদেন-পত্নীর মধ্যে তিনি একজন।  

২০০১ সালে মার্কিন আক্রমণের পর সপরিবারে আফগানিস্তান ত্যাগ করেন ওসামা বিন লাদেন। ২০১১ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি ছিল, পাকিস্তান লাদেনকে লুকিয়ে রেখেছে।  

বাবার মতো হামজার আস্তানা নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল সবসময়। তবে, বিভিন্ন চিঠিপত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে ধারণা করা হয়, ২০০৯ ও ২০১০ সালের দিকে তিনি ইরান ছিলেন। আরও কিছু প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, হামজা তেহরানে একটি বাড়িতে দুই স্ত্রী ও বোনের সঙ্গে থাকতেন। অন্য সূত্রের মতে, তিনি ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকায় আল কায়েদার কার্যক্রম পরিচালনা করলেও কখনোই ইরানে ছিলেন না।

আল কায়েদায় হামজা বিন লাদেনের দায়িত্ব কী ছিল, তা পরিষ্কার নয়। তবে, একটা বিষয় নিশ্চিত, ওসামা বিন লাদেনের বংশধর হামজাকেই ভবিষ্যৎ নেতা বলে মেনে নিয়েছিলেন আল কায়েদার সদস্যরা। তার হাত ধরেই লাদেন-হত্যার প্রতিশোধ ও নিজ দেশে ফের ক্ষমতাসীন হওয়ার আশা ছিল তাদের। আর, এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে নিজেকে বাপকা-বেটা বলেই প্রমাণ করছিলেন হামজা বিন লাদেন।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৯
একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।