ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

যে পাঁচ কারণে বরিসের পতন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০২২
যে পাঁচ কারণে বরিসের পতন

পদত্যাগ করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নয়, তিনি সরে গেছেন নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টি থেকে।

নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে নিজ দলের মন্ত্রী এবং সদস্যদের তোপের মুখে পড়ে এ সিদ্ধান্ত নেন বরিস।

দেশটির সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক অনুসন্ধানে বরিসের এ সিদ্ধান্তের কারণ খুঁজে বের করেছে। ‘বরিস জনসনের পদত্যাগ: যে পাঁচটি বিষয় হতে পারে পতনের কারণ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে তথ্যগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৮৭ সালের পর ২০১৯ সালে বিশাল জয় নিয়ে ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসেন বরিস। থেরেসা মে’র স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে নানা কারণে সমালোচিত হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের এ রাজনৈতিক।

ব্রিটেনের সাবেক ডেপুটি চিফ হুইপ ক্রিস পিনচারের কিছু বিষয়ে সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন বরিস জনসন। গত ২৯ জুন তিনি লন্ডনে একটি প্রাইভেট সদস্যদের ক্লাবে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করেন। কার্যত নিজেকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলে দেন। পিনচারের বিরুদ্ধে দুজন পুরুষকে জড়িয়ে ধরার অভিযোগ আনা হয়।

কনজারভেটিভ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও এমন অভিযোগের খড়্গ পরে বরিসের ওপর। বলা হচ্ছিল, তিনি তার দলের ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখেন না। পিনচারের নিয়োগের ব্যাপারেও সমালোচনা শুরু হয়। পরে ডাউনিং স্ট্রিট জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে ডেপুটি চিফ হুইপ হিসেবে পিনচারকে নিয়োগের আগে জনসন তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে জানতেন না। মন্ত্রীরাও একই কথা বলেন, কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়।

সোমবার (৪ জুলাই) বিবিসি জানায়, বরিস অভিযোগের বিষয়টি জানতেন। লর্ড ম্যাকডোনাল্ড নামে সাবেক এক কর্মচারী জানান, প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগের বিষয়টি জানানো হয়েছিল। পরে বরিসও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি জানান, ২০১৯ সালে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। এবং তিনি পিনচারকে ডেপুটি চিফ হুইপ নিয়োগের জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন।

বরিস সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন করোনাভাইরাস সংক্রমণকালীন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে মদ পার্টির আয়োজন করে। ২০২০ সালে লকডাউন নিয়ম ভেঙে নিজের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তিনি। এতে তাকে জরিমানাও দিতে হয়েছিল।

লকডাউনের সময় তিনি নিজে তো অনুষ্ঠান আয়োজন করেনই, আমন্ত্রিতদের বলা হয়েছিল নিজের সঙ্গে মদ নিয়ে আসতে। পরবর্তীতে ডাউনিং স্ট্রিট ও হোয়াইটহলে লকডাউন নিয়ম ভাঙায় বরিসসহ ৮৩ জনকে বিভিন্ন ধারায় মোট ১২৬টি জরিমানা করা হয়।

বরিসের মদ পার্টিকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করেছিলেন জ্যেষ্ঠ বেসামরিক কর্মচারী স্যু গ্রে। তিনি বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব, রাজনীতি ও কার্যালয়ভিত্তিক যে সংস্কৃতি রয়েছে ব্রিটেনে, বরিস তার সবগুলোই এ পার্টির মাধ্যম ভঙ্গ করেছেন। এর দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে জনগণের পাশাপাশি নিজ দলের সদস্যদের প্রবল চাপের মুখে পড়েন তিনি। সে সময় ধারণা করা হচ্ছিল, দোষ স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন বরিস। কিন্তু তা হয়নি।

পার্টিকাণ্ডের বিসয়ে তিনি কমন্সকে বলেছিলেন, সব নিয়ম মেনেই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে পুলিশি তদন্ত হয়। এতে বরিস দোষী বলে প্রমাণিত হন। বারবার এ বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী।

চলতি বছর যুক্তরাজ্যে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। যার বর্তমান হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যে কারণে দেশটিতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। নতুন এ সংকটের দায়ও বরিসের ওপর পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে তেলের ও খাদ্যের দাম বাড়ে। যা বরিসের নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যায়। এ সংকট সমাধানে তার সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেয়। জ্বালানি শুল্ক প্রতি লিটারে ৫ পাউন্ড কমিয়ে দেওয়া হয়। গত এপ্রিলে কর বৃদ্ধি করা হয় দেশটিতে। জাতীয় বীমা পাউন্ডে ১ দশমিক ২৫ পেন্স বেড়ে যায়।

শ্রমিক নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার এ ব্যাপারে সামলোচনা করেন। তিনি বলেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ জীবনযাত্রার ব্যয় দেখছে আমাদের দেশ। অথচ সরকার সরকার শ্রমজীবী ​​মানুষের উপর কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হাউস অফ কমন্স কমিটির তৎকালীন রক্ষণশীল সংসদ সদস্য ওয়েন প্যাটারসনও প্রধানমন্ত্রী বরিসকে সমালোচনার মুখে ফেলেছিলেন। ঘটনাটি ২০২১ সালের। এ বছর প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল।

ওয়েন প্যাটারসনের বিরুদ্ধে লবিং নিয়ম ভাঙার অভিযোগ উঠেছিল। তাকে যে সংস্থাগুলো অর্থ প্রদান করতো, তাদের সুবিধা দেওয়ার মতো অপরাধ করেছিলেন সাবেক এ ব্রিটিশ রাজনৈতিক।

এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য কনজারভেটিভরা বরিসের নেতৃত্বে প্যাটারসনকে বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করার পক্ষে ভোট দেন। তার অভিযোগের ব্যাপারে কীভাবে তদন্ত করা হয়, সেটি পর্যবেক্ষণে আরেকটি কমিটি করা হয়।

অনেক জলঘোলা হওয়ার পর ওয়েন প্যাটারসন পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে বরিস জনসন স্বীকার করেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি সঠিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বরিস জনসন ব্রেক্সিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পন্ন করেন। কিন্তু তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে ডাউনিং স্ট্রিটে ফোকাস ও ধারণার অভাব ছিল বলে সমালোচনা শুরু হয়।

বরিসের সাবেক উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংসও বিষয়টি নিয়ে তাকে অভিযুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অন্যান্য দলের নেতারা। গত জুনে কনজারভেটিভ সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জেরেমি হান্ট জনসনের বিরুদ্ধে সততা, যোগ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের অভিযোগ তোলেন।

সামগ্রিক বিষয়গুলোই বরিসের পতন নিয়ে আসে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে এখই সরে যাবেন না বলছেন বরিস। কিন্তু ব্রিটেনের পার্লামেন্ট মেম্বাররা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী সরে যাবেন।

বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) কনজারভেটিভ নেতার পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বরিস জনসন। তবে, আসছে শরৎ পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। চলতি গ্রীষ্মেই কনজারভেটিভ দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং আগামী অক্টোবরে একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী জনসনের স্থলাভিষিক্ত হবেন।

১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের একটি সূত্র বলেছে, জনসন তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে কনজারভেটিভ পার্টির ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যান স্যার গ্রাহাম ব্র্যাডির সঙ্গে কথা বলেছেন।

গত মঙ্গলবার (৫ জুলাই) থেকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মন্ত্রিসভা থেকে এরইমধ্যে ৪০ জনের বেশি সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এর ফলে শিগগিরই তার সরকারের পতন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সময় : ১৯৩৮ ঘণ্টা, ৭ জুলাই, ২০২২
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।