রজব হিজরি পঞ্জিকাবর্ষের সপ্তম মাস। রজব মুমিনের দরজায় পরম পুণ্যের মাস রমজানের অগ্রিম আগমনী বার্তা পৌঁছায়।
ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে রজব মাসের যোগসূত্র ও সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রিয় রাসুল (সা.) রজব মাসে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে আকাশপথে মেরাজে গমন করেছিলেন।
রাসুল (সা.) এর নবুয়ত লাভ-পরবর্তী ঘটনাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে বিস্ময়কর ও অভাবনীয় ঘটনা।
রজব মাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
রাসুল (সা.) এর কাছে সর্বপ্রথম রজব মাসেই ওহি অবতীর্ণ হয়। হিজরি পঞ্চম বর্ষের রজব মাসেই মুসলমানরা ‘হাবশা’র (বর্তমান ইরিত্রিয়া) উদ্দেশ্যে প্রথম হিজরত করেন। (উয়ুনুল আছর, ১/১৫২)
নবম হিজরির রজব মাসে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল; যাতে মুসলমানরা ত্যাগ-নিষ্ঠা ও কোরবানির পরাকাষ্ঠা উপস্থাপন করেছিলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ৫/১৯৫)
রাসুল (সা.) হাবশার নীতিবান বাদশাহ ও মুসলমানদের সহযোগী নাজ্জাসির মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং সেদিন ইসলামের ইতিহাসের একমাত্র গায়েবি জানাজা পড়েছিলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/৩৯)
১৪ হিজরির এ মাসে সিরিয়ার রাজধানী বিজয় মুসলমানদের হাতে এবং ১৫ হিজরির রজব মাসে ইয়ারমুকের মর্মান্তিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/০৭)
এছাড়াও ছোটখাটো অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছিল এই পবিত্র মাসে। তাফসিরে তাবারি ও বাগভিতে রয়েছে, আল্লাহর নবী নূহ (আ.) মহাপ্লাবনের আশঙ্কায় রজব মাসের ১০ তারিখে কিস্তিতে আরোহণ করেছিলেন। (মাআরেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা- ৬৩২)
রজব মাসের মর্যাদা ও তাৎপর্য
হিজরি বর্ষের অন্যান্য মাসের মধ্যে রজব মাস অতীব সম্মানিত ও মর্যাদাবান। তাৎপর্যবহ ও বরকতময়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই মহান আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা বারোটি। এর মধ্যে চারটি হচ্ছে (যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য নিষিদ্ধ) সম্মানিত। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। ’ (সুরা তাওবা-৩৬)
রজব মাস সম্বন্ধে নবী (সা.) থেকে হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, ‘বছর হচ্ছে বারো মাস। এর মধ্যে চার মাস হারাম (নিষিদ্ধ)। চারটির মধ্যে তিনটি ধারাবাহিক :জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও (মুদার গোত্রের) রজব মাস; যে মাসটি জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী। ’ (বুখারি-৪৬৬২ ও মুসলিম-১৬৭৯)
‘আশহুরুল হুরুম’ বা সম্মানিত এ চারটি মাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে।
রজব মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি
পবিত্র সিয়াম সাধনার বিশেষ গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে দুই মাস আগে রজব থেকেই এর মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) প্রতিবছর রজব মাস এলেই রমজানুল মোবারকের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। তার ইবাদত-বন্দেগি সব কিছুতেই একটি পরিবর্তন সূচিত হতো।
রজব সংক্রান্ত একটি হাদিসে আছে, রজব মাস আগমন করলে রাসুল (সা.) এই দোয়া করতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান। ’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের জন্য বরকত দান করুন আর রমজান পর্যন্ত আমাদের জীবিত রাখুন। ’ (বায়হাকি ফি শুয়াবিল ইমান, হাদিস নং: ৩৫৩৪, তাবরানি ফিল আওসাত, হাদিস নং: ৩৯৩৯, মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং: ২৩৪৬)
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ মোল্লা আলী কারি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘অর্থাৎ হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের ইবাদত-বন্দেগিতে বরকত দান করুন এবং রমজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিয়াম-কিয়াম তথা রোজা ও তারাবিহর তাওফিক দান করুন। ’ (মেরকাত-৩/৪৬৩)
রজব মাসে বিশেষ পদ্ধতির কোনো আমল নেই
শরিয়তের পক্ষ থেকে এ মাসের জন্য বিশেষ কোনো নামাজ, বিশেষ কোনো রোজা অথবা বিশেষ পদ্ধতির কোনো আমলের হুকুম নির্ধারিত নেই। রজব মাসে রোজা রাখা বা রজব মাসের কিছু অংশে রোজা রাখার ব্যাপারেও কোনো সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। তবে কিছু কিছু মানুষ রজব মাসের বিশেষ ফজিলত রয়েছে মনে করে এ মাসের বিশেষ কিছু দিনে যে রোজা রাখেন। কিন্তু শরিয়তে এ ধরনের আমলের কোনো ভিত্তি নেই। তবে ‘হারাম’ মাসগুলোতে (রজব অন্যতম) রোজা রাখা মুস্তাহাব মর্মে নবী (সা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং রোজা ভঙ্গও করো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৪২৪)
এ হাদিসটি যদি সাব্যস্ত হয়, তাহলে হারাম মাসে রোজা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণ হবে। অতএব, যে ব্যক্তি এ হাদিসের ভিত্তিতে রজব মাসে রোজা রাখে এবং অন্য হারাম মাসেও রোজা রাখে, এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে রজব মাসকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে বর্ণিত রোজার আলাদা কোনো প্রকার হাদিস নেই।
আসুন, রজব মাস থেকে পবিত্র রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ইসলাম যেসব ইবাদত-বন্দেগিকে সমর্থন দিয়েছে, সেগুলো মান্য করি এবং শরিয়ত-বহির্ভূত অন্য কাজকর্ম থেকে সর্বদা বিরত থাকি।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২৩
এসআই