গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো কাজের আগে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কল্যাণ কামনা করাকে ইসতেখারা (অনেকে এস্তেখারা বলেন) বলে। ইসতেখারার জন্য দু’রাকাত নফল নামাজ পড়া এবং নামাজান্তে মহানবী (সা.)-এর শেখানো বাক্যগুলো দ্বারা দোয়া করা উত্তম।
মহানবী (সা.) ইসতেখারার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে যেয়ে বলেছেন, ‘সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কাজের আগে আল্লাহর কাছে ইসতেখারা করে আর দুর্ভাগা তা করে না। ’ -মুস্তাদরাক
হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) যেভাবে আমাদের কোরআন শিখাতেন সেভাবেই প্রত্যেক কাজের ইসতেখারাও আমাদের শিখাতেন। তিনি বলতেন, যখন তোমরা কোনো কাজের মনস্থ করবে তখন দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বে। নামাজান্তে দোয়াতে বলবে, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে কল্যাণ চাই। তোমার কাছে শক্তি চাই। তোমার বিশাল দয়া চাই। কেননা, তোমার শক্তি আছে; আমার শক্তি নেই। তোমার জানা আছে; আমার জানা নেই। তুমি গায়েবের জ্ঞান রাখ। হে আল্লাহ! তুমি যদি জান যে, দুনিয়ায় এ কাজ আমার জন্য কল্যাণকর হবে, আমার জীবন যাপনের জন্য কল্যাণকর হবে, আমার আখেরাতের জন্য কল্যাণকর হবে- তবে এ কাজ আমার জন্য অতি সহজ করে দাও এবং এ কাজে বরকত দান করো। আর যদি তুমি জান যে, এ কাজ আমার জন্য ক্ষতিকর হবে, আমার জীবনের জন্য ক্ষতিকর হবে, আমার আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর হবে- তবে এ কাজকে আমার থেকে দূরে রাখ এবং আমাকেও এ কাজ থেকে দূরে রাখ। অতপর আমার জন্য যা কল্যাণকর তা যেখানেই থাকুক তার ব্যবস্থা আমাকে করে দাও এবং আমাকে খুশি করো। ’
দু’রাকাত নামাজ ও নামাজান্তে উক্ত দোয়া ইসতেখারার সঠিক নিয়ম। ইসতেখারা খুব সহজ একটি আমল। এটা যে কোনো মুসলমান অনায়েসেই আমল করতে পারেন। যারা আরবি বুঝেন তারা আরবিতে হাদিসের ভাষায়ই বর্ণিত দোয়াটি করবেন, এটাই উত্তম। কেননা, নবী করিম (সা.)-এর মুখের ভাষা ও বাক্যের বিশেষ বরকত আছে। আর যারা আরবি বুঝেন না তারা মাতৃভাষায়ও দোয়া করতে পারেন। হাদিসে ইসতেখারার নির্দিষ্ট কোনো সময় ও স্থানের কথা উল্লেখ নেই। আলাদা বিশেষ কোনো শর্তও বলা হয়নি।
তবে ইসতেখারা নিয়ে আমাদের সমাজে বহু ভুল বিশ্বাস ও আমল প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, ইসতেখারা করতে হয় রাতে ঘুমানোর আগে। অথচ সময়ের এ বাধ্যকতার কথা হাদিসে পাওয়া যায় না। আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন, ইসতেখারা করলে স্বপ্নে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। অথচ এ ব্যপারেও কোনো প্রতিশ্রুতি হাদিসে নেই। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। নবী ব্যতীত আর কারো স্বপ্ন ইসলামের নিকট প্রমাণ হওয়ার মর্যাদা ও গুরুত্ব রাখে না। তাই স্বপ্নের পিছনে ছোটা বা স্বপ্নের অপেক্ষা করা বৃথা।
অনেকেই মনে করেন, ইসতেখারা করাতে হয় মসজিদের ইমাম সাহেবের দ্বারা বা কোনো বুজুর্গ দ্বারা। এটাও চরম ভুল। মহানবী (সা.) অপর কাউকে দিয়ে ইসতেখারা করানোর শিক্ষা দেননি। বরং যে ব্যক্তি প্রয়োজনগ্রস্থ মহানবী (সা.) সরাসরি তাকেই ইসতেখারা করার আদেশ করেছেন। সুতরাং যার প্রয়োজন, যিনি কাজের মনস্থ করেছেন তিনি নিজেই নিজের ইসতেখারা করবেন, এটাই সুন্নত।
আবার ইসতেখারার নামে নতুন উদ্ভাবিত অনেক নিয়ম আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। বাজারের বিভিন্ন ওজিফার বইয়ে ইসতেখারার অনেক মনগড়া নিয়ম পাওয়া যায়। হাদিসে এ সবের কোনো উল্লেখ নেই। এ সব রীতি ও নিয়ম একেবারেই মনগড়া, যা অবশ্যই বর্জনযোগ্য।
অনেকেই ইসতেখারার নামে বিশেষ পদ্ধতিতে কোরআন শরিফ ঘোরে যাওয়া দ্বারা ইঙ্গিত গ্রহণ করে থাকেন। এরূপ করাটাও আলেমদের মতে কোরআনের সঙ্গে বেয়াদবি। এটা নিজেও করবেন না, অন্য কাউকে করতে দেখলে বিরত রাখবেন।
আবার ইসতেখারা নামের ভুল ব্যবহারও আমাদের সমাজে লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই না জেনে, বিভিন্ন তান্ত্রিক, কথিত ফকির-দরবেশ ও তাবিজদাতাদের কাছে যান বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। তখন তারা বলেন, এর জন্য ইসতেখারা করতে হবে, তাহলে আমি এটা জানতে পারবো! অথচ ইসলামের কথা হলো, এসব তাবিজদাতা তদবিরকারীদের গায়েব সংক্রান্ত বক্তব্যকে ইসতেখারা বলার কোনো অবকাশ তো নেই, উপরন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এটা জঘন্যতম পাপের কাজ। ইসলাম মনে করে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে গায়েবের কোনো খবর নেই, তাই অন্য কারো কাছে গায়েব জানতে চাওয়ার জায়েয নেই।
ইসতেখারা একটি বরকতময় সুন্নত আমল। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে এই সুন্নতের ওপর আমল করার তওফিক দান করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘন্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৫
এমএ