কালের পরিক্রমায় বিদায় নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে আরও একটি নতুন বছর। বিদায়ী বছরের হতাশা ও বঞ্চনাকে পেছনে ফেলে ভালো কিছু প্রাপ্তির স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বরণ করে নেবে নতুন বছরকে।
বস্তুত একটি বছরের বিদায় ও আগমনে প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য হলো, অতীত জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা তথা আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনার মাধ্যমে জীবনের হিসাব-নিকাশ পর্যালোচনা করা। তাই বছর শেষে আমাদের হিসাব করে দেখতে হবে, কেমন ছিল গত বছরে আমার আমলনামা। যদি যথেষ্ট পরিমাণ নেক আমল করে থাকি, তাহলে আলহামদুলিল্লাহ; আল্লাহ তা কবুল করে নিন। ভবিষ্যতে তা অক্ষুন্ন রাখুন এবং আরও বেশি নেক আমল করার তওফিক দিন। আর যদি মনে হয়, অবস্থা তার উল্টো, গুনাহর পরিমাণ বেশি, তাহলে বছর শেষে আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হয়ে তওবা-ইস্তেগফারের পাশাপাশি পুরনো পথে ফিরে না যাওয়ার পরিকল্পনা করা উচিত।
আসলে মানবজীবনে ভালো-মন্দের হিসাব গ্রহণ ও ভবিষ্যৎ জীবনের নতুন সংকল্প ভীষণ জরুরি। কারণ প্রত্যেকটি রাত-দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের আগমন ও প্রস্থান এ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা তাগিদ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি সেই সত্তা যিনি দিন ও রাতকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন। (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে কেবল) সেই ব্যক্তির জন্য যে উপদেশ গ্রহণ করতে ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়। ’ -সূরা ফুরকান : ৬২
মানুষ হিসেবে আমরা খুবই আত্মভোলা। তাই আমরা বিদায়ী দিনগুলোর কথা খুব একটা ভাবি না। অতীতের হিসাবের খাতা উল্টে দেখতে চাই না। উটপাখির মতো মুখ বুজে অতীতকে ভুলে থাকতে বেশি পছন্দ করি। তদ্রূপ ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও উদাসীন থাকি। ফলে আমাদের জীবন ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না। অথচ নতুন বছরকে সুন্দর, উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য অতীত জীবনের হিসাব-নিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সুন্দর ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনা প্রয়োজন। মুসলমান হিসেবে এটা করতে না পারা আমাদের জন্য বেশ লজ্জাকর বিষয়ই বটে।
ইসলামের দৃষ্টিতে একটি বছরের বিদায় ও আরেকটি নতুন বছরের আগমনের মধ্যে প্রকৃত মুমিনের জন্য রয়েছে চিন্তার খোরাক। আমাদের চিন্তা করতে হবে, এভাবেই তো আমাদের জীবন থেকে খসে পড়ছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এভাবেই একদিন নিভে যাবে জীবনপ্রদীপ। যেদিন আমার যাত্রা শুরু পরকালের তরে, আমি পাড়ি দিতে পারব তো আখেরাতের সেই কঠিন ঘাঁটিগুলো? আমার সঞ্চয় কি যথেষ্ট? একবার হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবায় তিনি যা বলছিলেন তার মর্মার্থ হচ্ছে, ‘হে জনতা! তোমাদের জীবন তরীতে রয়েছে কিছু মাইলফলক, সে মাইলফলকগুলো তোমাদের অতিক্রম করতে হবে। এভাবে তোমাদের রয়েছে একটি শেষ মঞ্জিল। সেখানেই ঘটে যাবে সবকিছুর ইতি। মুমিন মূলত দুটি আশঙ্কার মাঝে বসবাস করে। একটি আশঙ্কা হচ্ছে গত জীবন। সে জানে না, সেখানে আল্লাহ তার জন্য কী লিখে রেখেছেন। তাই প্রতিটি মানুষ নিজের জীবন থেকেই নিজের জন্য পাথেয় জোগাড় করুক। দুনিয়া থেকেই আখেরাতের সম্বল হাসিল করুক। বুড়ো হওয়ার আগে যৌবন ও সুস্বাস্থ্যকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করুক। সর্বোপরি মৃত্যু আসার আগে জীবনের সদ্ব্যবহার করুক। ’
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরেক হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে অন্য পাঁচটি বিষয় গ্রাস করার পূর্বে তার সদ্ব্যবহার করো। তোমার যৌবনকালকে বার্ধক্য আসার পূর্বে, তোমার সুস্বাস্থ্যকে অসুস্থতা আসার পূর্বে, সর্বোপরি তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার পূর্বে। ’
অতএব আসুন, এই নিয়ামতগুলো হারানোর পূর্বেই আমরা সেগুলোর সদ্ব্যবহার করি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘হে মানুষ! তোমার হিসাব চাওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব খতিয়ে দেখ! দাঁড়িপাল্লায় তোমার (ভালোমন্দ) আমলের ওজন করার পূর্বে নিজের আমল ওজন করে দেখ। আল্লাহর দরবারে চূড়ান্তভাবে নিজেকে পেশ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করো। ’ এরপর তিনি তেলাওয়াত করেন, ‘ওই দিন তোমাদের পেশ করা হবে (আল্লাহর সম্মুখে), তোমাদের কোনো গোপনীয়তাই গোপন থাকবে না। ’ -সূরা আল হাক্বাহ : ১৮
এই আয়াতের আলোকে বলা যায়, মুসলমানের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখণ্ড। সে প্রতি মুহূর্ত আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়। বরং তা মানুষের পুরো জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নির্দেশ অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উপদেশ দেয়। সে জন্য মুসলিম জাতির আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকার মাঝেই নিহিত। তাই তাদের প্রতিটি কাজের মাঝে জড়িয়ে থাকবে তাদের আল্লাহর আদেশ-নিষেধের সীমারেখা।
মানবজীবনের সময়গুলো অত্যন্ত মূল্যবান। প্রতিটি মুহূর্ত আখেরাতের বিশাল জিন্দেগির জন্য পাথেয় তৈরির এক অপূর্ব সুযোগ। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সে-ই বুদ্ধিমান যে নিজের হিসাব কষে ও পরকালের জন্য তৈরি হয়। ’ আর একজন সচেতন মুসলমানের গুণাবলির মাঝে রয়েছে তার ধর্মীয় মূল্যবোধ, আখেরাতের প্রতি অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা, ঐক্য, জাতীয়তাবোধ, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা। আদর্শ নাগরিকের এ গুণগুলোকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
তাই নতুন বছরের সূচনালগ্নে সবার কাছে প্রত্যাশা- আসুন, পুরনো বছরের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, হানাহানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলি। পুরনো বছরের পাপগুলো হিসাব করে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চাই। আর নতুন বছরে পুরনো পাপগুলো দ্বিতীয়বার না করার দৃঢ় সংকল্প করি। কারণ, দৃঢ় সংকল্প জীবনবোধ ও চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘন্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৫
এমএ