মুসলিম উম্মাহ যে সব মহামানব থেকে আধ্যত্মিকতার শিক্ষা লাভ করেছে, যাদের সার্বিক পরিচর্যায় ইসলামের আধ্যাত্মিকশাস্ত্র পূর্ণ অবয়ব পেয়েছে হজরত হাসান বসরি (রহ.) সে সব সফল সাধক কীর্তিমানের পুরোধাদের অন্যতম।
জন্ম
হজরত হাসান বসরি (রহ.)-এর পূর্বপুরুষরা ইরাকের বসরা ও ওয়াসিতের মধ্যবর্তী সায়লাসান নামক অঞ্চলে বসবাস করতেন।
এ শিশু বড় হয়ে জীবনের বড় একটা অংশ বসরাতে কাটান তাই পরবর্তীতে হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর দেয়া হাসান নামের সঙ্গে লোকমুখে বসরি শব্দ যোগ হয়। আজ সারা দুনিয়া ‘হাসান বসরি’ নামে তাকে চিনে থাকে।
শৈশব
তার মায়ের সুবাদে তিনি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী উম্মে হাবীবার নূরানী ঘরে শৈশব জীবন কাটান। গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত থাকায় মাকে কাছে না পেয়ে শিশু হাসান কান্না জোড়ে দিলে উম্মত জননী নবীপত্নী উম্মে সালামা (রা.) তাকে পরম মাতৃস্নেহে কোলে তোলে নিতেন। আদর, সোহাগ ও ভালোবাসা দিয়ে শিশু হাসানের কান্না থামাতেন।
শিক্ষা-দীক্ষা
হজরত হাসান বসরি (রহ.) বিভিন্ন সাহাবি থেকে শিক্ষা অর্জন করেছেন। তবে বিশেষ পরিচর্যা পেয়েছেন হজরত আলী (রা.) থেকে। হজরত আলী (রা.) তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন।
তাবেয়ি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন
গবেষকদের মতে তিনি সত্তরজন বদরি (যে সব সাহাবি বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাদের বদরি সাহাবি বলা হয়) সাহাবিসহ মোট ১৩০ জন সাহাবির সংশ্রব ও সঙ্গ লাভ করে তিনি তাবেয়ি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। হাসান বসরি যে সব সাহাবির সংশ্রবে আসেন, তাদের অন্যতম হলেন, উম্মত জননী উম্মে সালামা (রা.), ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) অন্যতম।
রাজনীতি ও জিহাদে অংশগ্রহণ
তিনি কোনো ক্ষমতাসীনের অন্ধভক্ত ছিলেন না। যে কোনো খলিফা, গভর্ণর কিংবা প্রশাসকের অনুচিৎ ও অন্যায় কাজ দেখলে তিনি ভদ্রোচিত ভাষায় এসবের সমালোচনা করতেন। এ ব্যপারে কারো পরোয়া করতেন না। এমনকি হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মতো অতি কঠোর প্রকৃতির শাসকের সমালোচনা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। শেষ পর্যন্ত তিনি হাজ্জাজের বিরাগভাজন হয়ে হাজ্জাজের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আত্মগোপন করে থাকেন।
তবে তিনি খলিফার এসব অন্যায়-অত্যাচারের বিরোধিতা করতে অস্ত্র হাতে নেয়ার ঘোরবিরোধী ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, ‘শাসকদের অত্যাচার আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের গুনাহের শাস্তি। অস্ত্র দিয়ে এর প্রতিরোধ সম্ভব নয়। ধৈর্য দিয়েই এর মোকাবেলা করতে হবে। ’ এমন নরম প্রকৃতির হাসান বসরিকে দুনিয়ার মানুষ আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে জানলেও ইসলামের খাতিরে; দ্বীনের প্রয়োজনে তিনি বেশ কয়েকবার জিহাদেও অংশ নেন।
ধর্মপ্রচার
ইসলামের আদর্শ প্রচারে তিনি জীবনের বেশি অংশ ব্যয় করেছেন। প্রতি শুক্রবারে তিনি মসজিদে ওয়াজ করতেন। মানুষকে ধর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ করতে ও গুনাহের কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন উপমা দিয়ে চমৎকারভাবে কথা বলতেন। আরবি ভাষার উপদেশমূলক এমন কোনো গদ্য সাহিত্য পাওয়া যাবে না যাতে হজরত হাসান বসরির উক্তি উদ্ধৃত হয়নি। তার অনেক উপদেশ আরবি ভাষার বিভিন্ন প্রামাণ্য অভিধানে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থান লাভ করেছে।
তার কিছু উপদেশ
১. পৃথিবীকে এমন এক সেতু মনে করো যার ওপর দিয়ে তুমি ওপাড়ে যাবে। তাই তুমি এর ওপর কিছুই নির্মাণ করো না।
২. তুমি দিনে নিজেকে গুনাহ থেকে মুক্ত রাখো। আল্লাহ তোমাকে রাতে আমল করার তওফিক দান করবেন।
৩. গরিবদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখো। কেননা, কিয়ামতের দিন তাদের বলা হবে, তোমাদের সঙ্গে যারা বন্ধুত্ব করেছিল অথবা তোমরা যাদের ভালোবাসত তাদের সঙ্গে নিয়ে জান্নতে প্রবেশ করো।
৪. মুমিন সে ব্যক্তি, যে আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহ যা করতে বলেছে তা করে এবং আল্লাহ যা করতে নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থাকে।
মৃত্যু
৫ রজব ১১০ হিজরি মোতাবেক ৭২৮ খ্রিস্টাব্দের শুক্রবারে এ মহান কর্মবীর সাধক পুরুষ মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। কিয়ামতের অপেক্ষায় বসরার মাটিতে তিনি আজও শোয়ে আছেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করুন। আমীন।
লেখক : খতিব ও মুহাদ্দিস
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘন্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৫
এমএ/