মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.)। যার কর্মগুণে ‘খতিব’ শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ সম্মানের শব্দ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
খতিব বললে এখনো চোখে ভেসে ওঠে যার নাম, সেই অমর ব্যক্তিত্ব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) ২০০৭ সালের ৬ অক্টোবর ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। অাজ তার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের দিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার পাশাপাশি আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করি- হে আল্লাহ! তুমি তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করো।
খতিব উবায়দুল হক (রহ.) প্রথাগত আলেম ছিলেন না। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। আমাদের জাতীয় ও সমাজজীবনে তার রয়েছে বহুমুখী অবদান। তিনি ছিলেন খুবই স্পষ্টভাষী। সারাজীবন সাদাকে সাদা- আর কালোকে কালো বলে গেছেন। তার মাঝে কোনো গোড়ামি ছিল না, তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, সদালাপী ও দরাজ কণ্ঠের অধিকারী।
খতিব উবায়দুল হক (রহ.) ১৯২৮ সালের ২ মে সিলেট শহর থেকে ৭৪ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বারোঠাকুরিতে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকাল থেকেই তার শিক্ষাদীক্ষার সূচনা হয়েছিল পরিপূর্ণ ইসলামি আবহে। কৈশোরের সীমা অতিক্রম করা পর্যন্ত সুযোগ্য পিতার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। একই সঙ্গে পিতার একান্ত সাহচর্যে পরিপূর্ণ দ্বীনি চরিত্র গঠন করার সুযোগ লাভ করেন। ১৪ বছর বয়সে তাকে উচ্চশিক্ষার্জনের জন্য ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি ইসলাম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।
সাইয়্যেদ হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.), আল্লামা এজাজ আলী (রহ.) ও কারি মুহাম্মদ তৈয়ব (রহ.) প্রমুখ তার শিক্ষক ছিলেন। দেওবন্দ থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে দেশে ফিরে তিনি ঢাকার বড় কাটরার আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন ভারতের শাহজাহানপুরে অবস্থিত একটি মাদ্রাসায় অধ্যাপনায়ও যুক্ত ছিলেন। তিনি মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিখ্যাত মাদ্রাসা দারুল উলুম করাচিতেও সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে দেশের একমাত্র সরকারি মাদ্রাসা ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ ঢাকায় তিনি যোগ দেন। পর্যায়ক্রমে তিনি হাদিস বিভাগের লেকচারার, সহকারী প্রফেসর, প্রভিশনাল হেড মাওলানা এবং ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত হেড মাওলানা পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৮৫ সালে ২ মে খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর গ্রহণের পর বিভিন্ন বেসরকারি মাদ্রাসায় হাদিসের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। শায়খুল হাদিস হিসেবে তিনি সুখ্যাতিও অর্জন করেন। তিনি ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, আজিমপুর মাদ্রাসা, চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসা, সিলেটের দরগাহ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব কৃতিত্বের সঙ্গে আঞ্জাম দেন।
খতিব সাহেব জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ, কাসিমুল উলুম মাদ্রাসা কুমিল্লা, মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী এবং সিলেট দরগাহ মাদ্রাসাসহ অনেক মাদ্রাসার মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কিংবা অভিভাবক ছিলেন।
তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতিবের পদে অধিষ্ঠিত হন। খতিব পদে নিয়োগের পরের ইতিহাস আরো বর্ণাঢ্য ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। তিনি বায়তুল মোকাররমের মেহরাবকে বিবেক ও অভিভাবকের এক মজবুত মসনদে পরিণত করেছিলেন। ধর্ম, দেশ, সমাজ ও উম্মাহর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তার যথার্থ সাহসী উচ্চারণ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছিল।
তিনি বায়তুল মোকাররমের খতিব হিসেবে সর্বদা মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিতেন। প্রতি জুমার দিন নিজের লেখা আরবি ভাষায় নতুন নতুন খুতবা প্রদান করতেন। সমসাময়িক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বক্তব্য পেশ করাই ছিল তার খুতবার বৈশিষ্ট্য। আরবিতে খুতবা প্রদানের আগে এর সারাংশ বাংলায় মুসুল্লিদের শুনিয়ে দিতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি খতিব পদে নিয়োজিত ছিলেন।
কর্মজীবনের নানা ব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি অনেক কিতাব লিখেছেন। বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ভিন্নমাত্রিক রচনাও রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত শতাধিক বইয়ের তিনি সম্পাদনা করেছেন।
বহুধাবিভক্ত ইসলামি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে গেছেন সারা জীবন। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, আন্তরিকতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সব ধর্মীয় দল ও উপদলের মাঝে ঐক্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধর্মীয় মতপার্থক্য নিরসন এবং ইসলামি ঐক্য সুসংহত করার লক্ষ্যে তিনি ‘জাতীয় শরিয়া কাউন্সিল’ নামে একটি অরাজনৈতিক স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠন করেন।
বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং ও বীমা চালুর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। এ ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখায় মাওলানা উবায়দুল হকের নাম নিঃসন্দেহে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
দেশে-বিদেশে ইসলাম ও শরিয়তবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপ এবং বিশ্ব মুসলিমের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে খতিবের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। এ ছাড়া দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী আন্দোলনে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার আহবানে দেশের আড়াই লাখ মসজিদে; একযোগে জঙ্গিবিরোধী খুতবা ও বক্তব্য প্রদান করেন ইমাম ও খতিবরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৫
এমএ/