ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অন্তত ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। ভয়াবহ এসব হামলায় কয়েক শ মানুষ আহত হন।
হামলার পর দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। দেশের নাগরিকদের ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তা বুঝতে আর বাকী নেই।
প্যারিসে এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা শোনার পর থেকেই নানা ভাবনা মনে ঘুরছে। বরাবরের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। আজ (১৪ নভেম্বর) সকালে অনলাইনে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আইএস দাবি করে, ‘বিস্ফোরক কোমরবন্ধনী পরে ও অস্ত্র হাতে নিয়ে আমাদের আট ভাই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সফল হামলা করেছে। ’
এ বিবৃতি প্রকাশের পর আমার মনে প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মের নামে এত বড় অধর্ম আর কি হতে পারে? মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। সে যে দল বা মতেরই হোক না কেন- এভাবে তাদের মারার অধিকার কোন ধর্ম দিয়েছে? কোন ধর্মীয় নেতা, কোন ধর্মীয় বিধান- এভাবে নিরপরাধ নিরীহ মানুষের ওপর এমন হামলার কথা বলেছে? আর কতকাল চলবে ধর্মকে ভাঙিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে স্বার্থ হাসিলের ধান্ধা? বলি- এমন সন্ত্রাসী কার্য্যকলাপ করে ইসলামের কোন উপকারটুকু হচ্ছে? আমাদের কথা স্পষ্ট, এসব কাজ ধর্ম সমর্থন করে না, এসবের সঙ্গে দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। যারা এসব করছে, তারা ইসলামের শত্রু, মানবতার শত্রু। তাদের প্রতিহত করা, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব।
আমরা জানি, লাখো সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে নিপতিত বর্তমান বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো সন্ত্রাস। সন্ত্রাস আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের এক মরণ ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাস মানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, পঙ্গু করা, অধিকার হরণ, প্রতিশোধ গ্রহণ, তথা হত্যা, ধ্বংস, লুণ্ঠন, জিঘাংসা, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি। পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েন ও স্বার্থান্ধতা থেকেই জন্ম নেয় এক ধরণের বিকৃত মানসিকতা, যার সর্বশেষ পরিণতি দাঁড়ায় সর্বসংহারী সন্ত্রাস।
সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সন্ত্রাসের ব্যাপকতা সম্প্রতি গোটা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। বিভিন্ন সম্মেলনে, সুপারিশমালা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ও লেখনীতে সন্ত্রাসের কারণ, উৎপত্তি, প্রকৃতি, অর্থের উৎস, কুফল, প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস নির্মূলের সার্বিক প্রচেষ্টা ও অকান্ত পরিশ্রম অব্যাহত রয়েছে। কোটি কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এ খাতে।
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস দমনের চেষ্টা ও সন্ত্রাসের বিস্তার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তাহলে এর সমাধান কি? সন্ত্রাস দমনের সঠিক কর্মপদ্ধতিই বা কি? এ ব্যাপারে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
সন্ত্রাসের স্থান ইসলামে নেই। বরং ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে সন্ত্রাস, অরাজকতা, জুলুম, শক্তির মহড়া, ছিনতাই, লুণ্ঠন, হত্যা, রাহাজানি ইত্যাদি মানবতা বিধ্বংসী কার্যক্রম সমূলে উৎখাত করে কাঙ্ক্ষিত কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। মহান আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা হলে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি। মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখবে। ’ –সূলা আল ইমরান: ১১০
যুগ যুগ ধরে মানব সমাজে সন্ত্রাস নামক যে ধ্বংসলীলা বিদ্যমান, ইসলাম একে ফিতনা ও ফাসাদ নামে অভিহিত করেছে। পবিত্র কোরআনে কারিমে শব্দদুটি যথাক্রমে ৩৪ ও ৪৯ বার বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন অর্থে উল্লিখিত হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা সন্ত্রাসকে সমূলে বিনাশ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাক, যে পর্যন্ত না ফিতনা নির্মূল হয় এবং দ্বীন শুধু আল্লাহরই জন্য হয়ে যায়। ’ –সূরা আল বাকারা: ১৯৩
হত্যা, সন্ত্রাস, জিঘাংসা, নির্যাতন নয়, পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সহানুভূতি, সহনশীলতা, জীবনের নিরাপত্তা দানের শিক্ষা দেয় ইসলাম। শুধুমাত্র মুসলমান নয়- ইসলালম অমুসলিমদের ইজ্জত-আবরু, সম্পদ ও জীবন সংরক্ষণের তাগাদা দিয়েছে। সংখ্যগুরু ও সংখ্যালঘু বিবেচনায় জাতি বিভাজনের মাধ্যমে হত্যা, সন্ত্রাস, লুণ্ঠনের কোনো অবকাশ ইসলামে নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ইনসাফ (ন্যায়বিচার) বর্জনে প্ররোচিত না করে। ন্যায় বিচার কর। এটাই আল্লাহ ভীতির অধিক নিকটবর্তী। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। ’ –সূরা আল মায়িদা: ৮
একথা সতঃসিদ্ধ যে, ইসলামের যাবতীয় কার্যকরী পদক্ষেপ সকল যুগের, সকল পরিবেশের, সকল মানুষের। তাই বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষে সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছি। সেই সঙ্গে প্যারিনের ঘটনায় হতাহতের প্রতি জ্ঞাপন করছি গভীর সমবেদনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
এমএ/