মানুষের ভেতরে ভালো এবং মন্দের লড়াই নিরন্তর। মনের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে মন্দ শক্তি সবসময় চেষ্টা করে মানুষকে বিপথে টেনে নিতে।
মানুষকে কখনো বিপথগামী হতে দেখলে, নৈতিকতা অশনি সংকেত হিসেবে সতর্ক করে তোলে। মূলত এই শক্তিশালী নৈতিকতাই হলো আল্লাহর প্রতি ইমান। কেবল এই ইমানই পারে মানব গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে এবং মানব অস্তিত্বের ওপর সমূহ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।
ভালো-মন্দের এই লড়াইটা বুঝতে পারাটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষের এই বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি ও চিন্তাশীল মনোভাবের জন্য তারা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। সে হিসেবে বলা যায়, মানুষ চাইলে তার নিজের ভেতরটাকে নৈতিকতার বিচিত্র গুণে গড়ে তুলতে পারে। নিজের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে এমনকি তার আচার-আচরণে যদি তার ওই গুণ পরিলক্ষিত হয়- তাহলে তা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তেমনিভাবে নৈতিক গুণ ব্যক্তির ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্য নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নৈতিক গুণাবলির গুরুত্ব এতো বেশি যে, একজন মানুষ যদি সব জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করে; এমনকি প্রকৃতির সব শক্তির ওপর নিজের আধিপত্য বিস্তারও করে; তাতে কোনো লাভ নেই। যদি না ওই লোক নিজের ভেতরের শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিজের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারলে প্রকৃত উন্নতি ও সৌভাগ্য অর্জন করা থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে।
জ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি সকল উন্নয়ন সত্ত্বেও আচরণগত সংস্কার করা না হলে ওই উন্নয়ন হবে সেই আকাশচুম্বী প্রাসাদের মতো, যেটা গড়ে তোলা হয়েছে সুপ্ত আগ্নেয়গিরিময় পাহাড়ের ওপর। সুতরাং মানুষের নৈতিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণ এক কথায় মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ প্রত্যেক সমাজের জন্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
পৃথিবীজুড়ে আজ যে অস্থিরতা, অশান্তি, গোলোযোগ, বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মারামারি, হানাহানি, অরাজকতা- সবই ওই নৈতিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণহীনতা থেকেই উৎসারিত।
বর্তমান বিশ্ব শিল্প ও জ্ঞানের ভুবনে অনেক উন্নতি করেছে। এগুলোর সাহায্যে তারা মানুষের পার্থিব জগতের বিচিত্র চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু মানবীয় নীতি নৈতিকতার দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে, এতোকিছুর পরও মানুষ পতনের অতল গহ্বরে পড়ে আছে কিংবা সেদিকে অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো শান্তি নেই।
বস্তুত মানুষের আত্মিক প্রশান্তির ক্ষেত্রে ধর্ম কিংবা নৈতিকতার উপস্থিতিই শুধু পারে শান্তি দিতে। এই মূলনীতি মানুষ ভুলে শান্তির জন্যে হাহাকার করছে। এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার জন্যে ইসলাম ধর্মে রয়েছে পরিপূর্ণ এবং যথার্থ দিক-নির্দেশনা। আধুনিক গবেষণাতেও দেখা গেছে, ধর্মীয় আচার-আচরণ, নৈতিকতা এবং বোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে।
বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে এমন সব হুকুম আহকাম এবং নীতিমালা রয়েছে, যেগুলো মানুষের আত্মার প্রশান্তি নিশ্চিত করে এবং শারীরিক সুস্থতাও বজায় রাখে। উপরোক্ত বিষয়কে ইসলামি নীতিমালার আলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
এক. বিশ্বাসের মূলনীতি, দুই. আদেশ ও তিন. নৈতিকতা।
এই তিনটি বিভাগ মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেখুন, ধর্মীয় নীতিমালা যদি বলে; পবিত্র খাবার খাও এবং দূষিত খাবার পরিহার করো। তাহলে ধরে নিতে হবে মানুষের স্বাভাবিক চাহিদার সঙ্গে এই আদেশ যথোপযুক্ত এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ইসলাম এভাবে আদেশ দিয়েছে। কিংবা যদি বলে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সামনে বিনয়ী ও অনুগত হও এবং তার ইবাদত করো। তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই মানবীয় প্রকৃতির সঙ্গে তার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
একইভাবে সমজাতির প্রতি সদয় হওয়া, বাবা-মায়ের সেবা-যত্ন করা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, মিথ্যা পরিহার করা, গীবত না করা, অহমিকা প্রদর্শন না করা ইত্যাদিসহ এ ধরনের অন্যান্য নৈতিক অবক্ষয়মূলক প্রবণতা থেকে যদি বিরত থাকার কথা বলা হয়, তাহলে বুঝতে হবে মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সঙ্গে এটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আসলে ধর্মের অর্থ হলো, যৌক্তিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ঔচিত্যবোধ ও বিশ্বাসগুলোর সঙ্গে সামগ্রিকভাবে সম্পৃক্ত থাকা। আর এ পথেই রয়েছে শান্তির বার্তা।
কেননা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, তাদের স্বাভাবিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্যে যা যা দরকার সেগুলোর ভিত্তিমূলেই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চাই হলো, মানুষের আত্মবিশ্বাস ও নিজস্ব মেধার বিকাশসহ মানসিক সুস্থতার মৌলিক চালিকাশক্তি। তাই মানুষের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের জন্যে যা কিছুই ক্ষতিকর- চাই অল্প সময়ের জন্যেই হোক কিংবা দীর্ঘমেয়াদের জন্যেই হোক- সে সবই হারাম বলে ঘোষণা করেছে ইসলাম। আর যেসব জিনিস উন্নয়ন ও বিকাশের অনুকূল সে সবই মানুষের জন্যে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। এভাবেই ইসলামের শিক্ষা ও নীতিমালাগুলো মানুষের সকল মনোদৈহিক সুস্থতা নিশ্চিত করেছে। এর মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এমএ/