ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে ইসলামের মূল্যায়ন

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে ইসলামের মূল্যায়ন

বুদ্ধিবৃত্তি অতি শ্রেষ্ঠ কর্মরূপে গণ্য। কারণ, মানুষ সৃষ্টির সেরা শুধু এ বিশেষ গুণের কারণে।

দৈহিক শক্তি বা অন্য কোনো কারণে নয়। বুদ্ধির প্রয়োগকে ইসলাম শুধু সিদ্ধই বলেনি বরং এর প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছে। ইসলাম শিক্ষাকে যেমন প্রতিটি নর-নারীর ওপর ফরজ করেছে; তেমনি ফরজ করেছে বুদ্ধিচর্চাকেও। সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায়ের উপলদ্ধিতে অতিশয় জরুরী বিষয় হলো, ব্যক্তির চিন্তার সামর্থ্য। একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিই মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠে সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে ভাবতে ও ত্যাগে উৎসাহিত করে।

তাই তো বুদ্ধিজীবীদের বলা হয়, জাতির মূল চালিকাশক্তি। শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে সুষ্ঠু ও আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার সন্ধান দেন বুদ্ধিজীবীরা। তাই মানবতার ধর্ম ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে জড়িতদের সর্বদা সম্মানের চোখে দেখে তাদের অভাবনীয় সম্মান প্রদান করেছে। খন্দকের যুদ্ধে হজরত সালমান ফারসির (রা.) মতো বুদ্ধিজীবী সাহাবির পরামর্শ নিয়ে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করে মদিনার সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)।

বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে জড়িত জ্ঞানী ব্যক্তিদের ইসলাম যুদ্ধাবস্থায়ও সম্মান প্রদর্শন করেছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দি অমুসলিম জ্ঞানীদের মুক্তিপণ হিসেবে আর্থিক সুবিধার বদলে তারা কোনো মুসলমানকে অক্ষরজ্ঞান দান করলে মুক্তি দেওয়া হবে- এমন শর্ত নির্ধারণ করতেন। জ্ঞানীদের জ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গে এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘রাতের কিছু সময় জ্ঞানচর্চা করা সারারাতের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। ’

আমরা জানি, রাজনৈতিক আগ্রাসনে লুণ্ঠিত হয় পরাজিত জাতির সম্পদ। লুণ্ঠিত হয় তার মানবিকতা ও চরিত্র। বিনষ্ট হয় আদর্শিক পরিমণ্ডল। তখন পরাজিত মানুষের পক্ষে নিজের মতো করে বেড়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অথচ নৈতিক এ সম্পদ একটি জাতির জন্য অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ উৎপাদন করা হয় না বা গড়ে উঠে না। বরং গড়ে ওঠে জাতির চেতনালোকে। যার নির্মাণে কাজ করে একটি ধর্ম বা আদর্শ এবং সে ধর্ম বা আদর্শের পতাকাবাহী বুদ্ধিজীবীরা। যে কোনো জীবন্ত ও সুস্থ জাতির জীবনে এ প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল থাকা শুধু কাঙ্ক্ষিতই নয়, অপরিহার্যও বটে। একটি জাতির উন্নত ও সভ্যতর হওয়ার পেছনে এই হলো মূল চালিকাশক্তি। তাই একটি বিশুদ্ধ আদর্শ ও সে আদর্শের বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব অনেক বেশি।

ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়। এটা হলো মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। ইসলামের কারণেই প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের হাতে নির্মিত হয়েছিল সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। ইসলাম কোনো হত্যাকাণ্ডই সমর্থন করে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ইসলামের নামে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল। তাই তাদের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী। বাস্তবে হয়েছেও তাই। হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের পতনকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা শাস্তি বা গজব বললে বোধহয় ভুল হবে না। এ প্রসঙ্গে হজরত আলী (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নির্যাতিতদের বদ দোয়াকে ভয় করো। কেননা সে আল্লাহর কাছে নিজের অধিকার প্রার্থনা করে। আর আল্লাহতায়ালা কোনো হকদারকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন না। ’

আর বাস্তবতাও এটা যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশীয় জনগণ ছিল সম্পূর্ণভাবে নির্যাতিত। এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্য থেকে কারও ওপর অন্যায়ভাবে অস্ত্র প্রয়োগ করল, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ’

সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে ইসলামের এমন সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ন্যায় ও সত্যের টুঁটি চেপে ধরে নির্লজ্জের মতো স্বার্থান্বেষী একটি মহল স্বাধীনতা লাভের পূর্বমুহূর্তে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে জাতিকে অভিভাবকশূন্য করতে চেয়েছিল।

ইসলামি শরিয়তে অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করা নিষিদ্ধ। মানুষ তো দূরের কথা, কোনো সাধারণ প্রাণীকেও হত্যা করা বা কষ্ট দেওয়া ইসলাম মুসলমানদের জন্য অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ জন্যই তো ইসলামকে মানবতার ধর্ম বলা হয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমের সূরা আনআমের ১৫১নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, 'আর তোমরা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করো না। '

কোরআনে কারিমের অন্যত্র এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শাস্তি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, 'যে ব্যক্তি মানুষ হত্যার অপরাধ বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজের হেতু ছাড়া কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমস্ত মানুষকেই হত্যা করল। ' -সূরা মায়েদা : ৩৬

এমনিভাবে হাদিস দ্বারাও অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। ইরশাদ হচ্ছে, 'একজন মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত-সম্মানে হস্তক্ষেপ করা সম্পূর্ণ হারাম। '

অন্যত্র আরও ইরশাদ হচ্ছে, 'যে আমার উম্মতের মধ্য থেকে কারও ওপর (অন্যায়ভাবে) অস্ত্র প্রয়োগ করল সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। '

সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম যেহেতু কারও জন্যই কল্যাণকর নয়; বরং মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর এবং সীমাহীন অকল্যাণকর। তাই ইসলাম কখনও একে সমর্থন করেনি। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাউকে কখনও সামান্যতম সহায়তাও করেনি। দেখায়নি কোনো সহানুভূতিও। এটাই ইসলামের দর্শন।

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি ও কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর চালায় নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের এসব বরেণ্য ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী সেসব শহীদদের আমরা স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে।


বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।