দু’টো সন্দেহাতীত বিষয় আছে। এক. হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
১. তৎকালীন আরবের কাব্য সাহিত্য খুবই উঁচুমানের ছিল (বলা হয় যে পরবর্তীকালে কখনও ওই মানে পৌঁছে নাই )। তাই আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমের অননুকরণীয় ভাষা-বর্ণনার মাধ্যমে কাফেরদেরকে স্তব্ধ করে দেন;
২. আর আল্লামা জমখশরি এবং জুরজানি ব্যতিত কোরআনের মুজেযা আর কেউ প্রকৃতভাবে বুঝেননি।
আসলে এই কথাগুলো মানুষকে কোরআন থেকে দূরে সরানোর জন্য যথেষ্ট। কারণ প্রথম কথায় কোরআনকে এক ধরনের সাহিত্য বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ কোরআন না গল্প, না উপন্যাস, না কবিতা, না নাটক না এ জাতীয় অন্য কিছু। অর্থাৎ সাহিত্য গ্রন্থ বলতে যা বুঝায় কোরআন তার কোনো পর্যায়েই পড়ে না।
দ্বিতীয় বক্তব্যে ক্ষেত্রে বলতে হয়, জমখশরি এবং জুরজানি উভয়ে ছিলেন বালাগাত তথা আরবি ব্যকরণের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পণ্ডিত। পৃথিবীতে সবাইতো আর জমখশরি কিংবা জুরজানি হবে না। কোরআনের মুজেযা বুঝার জন্য উচ্চমানের আরবি জানাকে যদি শর্ত করা হয়, তবে সাধারণ মানুষ কিভাবে উপলব্ধি করবে যে, কোরআন একটি মুজেযা?
তবে হ্যাঁ, এতটুকু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, কোরআনের সরফ-নাহু-বালাগাত ইত্যাদি সংক্রান্ত মুজেযা বুঝতে হলে আরবি ভাষা ও ব্যকরণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান জরুরী। কিন্তু সার্বিকভাবে কোরআনের ব্যাপারে এ কথা কেবল বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি করে। কারণ, মুজেযার প্রকৃতিই এমন যে, সেটার দর্শক ও শ্রোতা উপলব্ধি করতে বাধ্য হয় যে, এটা সরাসরি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার কাজ। কোনো সৃষ্টি তা করতে অক্ষম। কেবল হঠকারিতা কিংবা গোঁয়ার্তুমিবশতঃ এটাকে অমান্য করা যায়।
উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেন, সমবেত সকলেই তা প্রত্যক্ষ করেছিল। বর্ণিত প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরাও যদি হাজির থাকতাম, তাহলে আমরাও ওই সব মুজেযা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করতাম। কিন্তু আমরা তা প্রত্যক্ষ না করেও বিশ্বাস করেছি।
এবার আসা যাক কোরাআনে কারিমের ক্ষেত্রে। কোরআনে কারিম একটি মুজেযা, এ বিশ্বাস প্রতিটি মুসলমানের। কিন্তু কিভাবে উপলব্ধি করবে? উচ্চমার্গের তো দূরের কথা, সাধারণ আরবিও তো আমরা জানি না। আবার ইসলামি শরিয়তও সবার ওপরে আরবি ভাষা শেখাকে ফরজ করেনি। তাহলে কি আমরা কখনও উপলব্ধি করতে পারব না যে, কোরআন একটি মুজেযা?
এ প্রশ্নের উত্তর হলো, অবশ্যই পারব। কারণ কোরআনের মুজেযা সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য স্থান-কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয় বরং এটা চিরকালীন। তবে এই উপলব্ধির প্রয়োজনে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কোরআনের মুজেযা কেবল এর ভাষা আর সাহিত্যে বিদ্যমান, এমন চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে কোরআনকে দেখতে হবে এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, কোরআন মানুষের হেদায়েতের আঁকর। তখন খুব সাধারণ মানুষটিও হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পারবে, কোরআন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেযা।
চিত্ত যখন অস্থিরতায় উতাল-পাতাল, ভয়-আতঙ্কে হৃদয় যখন ছটফট করতে থাকে; তখন পরম ভক্তি-বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার সঙ্গে কোরআনকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখুন। উপলব্ধি করুন- অন্তর ঠাণ্ডা হয় কী না; মনে শান্তি আসে কী না। যুক্তিবাদীরা বলবেন যে, বিশ্বাসের কারণে এটা হচ্ছে। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে একই পরিমাণ ভক্তি-ভালোবাসা-বিশ্বাস নিয়ে মানব রচিত যে কোনো বই (বিজ্ঞানের-দর্শনের-সাহিত্যের, যে বিষয়ের হোক না কেন) ওইভাবে ধরে দেখুন, সেই একই শান্তি লাভ হয় কী না।
শুধু অনুরোধ, উভয়ক্ষেত্রে আপনি সত্য কথাটি অকপটে স্বীকার করবেন।
আসলে কোরআনের এই মুজেযা উপলব্ধি করার জন্য মস্তবড় পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো সময়ে (শর্ত শুধু সে যেন পাক-সাফ থাকে) উপলব্ধি করতে পারে।
‘কোরআন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, এমন কিছু যা বারংবার পড়তে হয়। কোরআন আপনি যতো বেশি তেলাওয়াত করবেন, ততো বেশি তেলাওয়াত করতে ইচ্ছা হবে। কখনও আপনার মধ্যে এই অনুভূতি আসবে না যে, অনেকবার তেলাওয়াত করা হয়েছে। অতঃএব, অরুচি চলে এসেছে। আপনি যদি অর্থ নাও বুঝেন, তারপরও আপনার তৃপ্তি মিটবে না। মানব রচিত কোনো গ্রন্থ যা আপনি বুঝেন না, পারবেন এরূপে পড়তে? বিশ্বাস না হলে আজই, এ মুহূর্তে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। অর্থ বুঝেন না, কেবল রিডিং পড়তে শিখেছেন এমন একটি গ্রন্থ নিয়ে বসুন। আপনার সাধ্যমতো হৃদয়ের সবটুকু ভক্তি-ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে পড়তে চেষ্টা করুন। সামনে একদল শ্রোতা রাখুন যারা আপনার মতো ওই গ্রন্থটির ভাষা বুঝে না।
অতঃপর দেখুন, পাঠক হিসেবে কতোক্ষণ আপনার ধৈর্য্য থাকে আর শ্রোতাদেরই বা কতক্ষণ ধৈর্য্য থাকে। কোরআনের এই মুজেযাটি আমরা প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি, কিন্তু কখনও উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না।
যে কোনো বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমরা শ্রোতাদেরকে তিনটি দলে বিভক্ত করতে পারি-
ক. মনোযোগী ও পছন্দকারী শ্রোতা;
খ. এমন একটি মানসিকতার অধিকারী যে শ্রুতিমধুর কিংবা আকর্ষণীয় হলে শুনবে না হলে ওঠে যাবে;
গ. যতোই আকর্ষণীয় হোক তারপরও শুনবে না, বরং অন্যদের শুনতেও বাঁধা দেবে।
এখন স্বাভাবিক যুক্তির খাতিরে ক এবং গ এই দুই দলকে বাদ দিয়ে শুধু খ দলের লোকের কথা বিবেচনা করুন। এমন একটি দলের সামনে কোরআন তেলাওয়াত করুন এবং মানব রচিত অন্য কোনো গ্রন্থ পড়ুন (গদ্য-পদ্য-নাটক-উপন্যাস-বিজ্ঞান-অর্থনীতি-দর্শন-রাজনীতি যে বিষয়েই হোক না কেন); উভয় ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করুন।
আপনি কী এই ইতিহাস পড়েননি, মক্কার কাফের সর্দাররা পর্যন্ত রাতের আঁধারে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোরআন তেলাওয়াত চুপি চুপি শুনতে যেত!
বোন আর বোন জামাইকে মুসলমান হওয়ার অপরাধে মারতে মারতে ক্লান্ত উমর বিন খাত্তাব নিতান্ত কৌতূহলবশতঃ জানতে চেয়েছিল তারা কী পাঠ করছিল। এ ঘটনাতো সর্বজনবিদিত। বস্তুত এটাই কোরআনে কারিমের মুজেযা। দুনিয়ার কোনো প্রলোভন ছাড়া হৃদয়ের বদ্ধ কপাট খুলে দেয় কোরআন- সুবহানাল্লাহ
দুনিয়ার সব ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে কোরআন নিয়ে বসুন; আর মনে মনে কল্পনা করুন- আপনি আল্লাহতায়ালার একজন আশেক (প্রেমিক)। আর কোরআন হচ্ছে মহান মাশুকের (প্রেমাস্পদের) পক্ষ থেকে প্রেরিত পত্র। যদিও আপনার বোধগম্য ভাষায় তা পাঠানো হয়নি। অতঃপর পড়তে থাকুন মাশুকের চিঠি। সততার সঙ্গে সাক্ষ্য দিয়ে বলুন তো, আপনার অন্তর আলোড়িত হয় কী না! ভাবের দরিয়ায় ঢেউ ওঠে কী না! পরম প্রশান্তি নিয়ে চিঠিখানা পড়ে শেষ করুন। মন কি চায়? আর একবার পড়ি! তাই নয় কি?
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
slkparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
এমএ
** ইতিহাসের প্রথম সিরাতগ্রন্থ
** মুসলমানদের স্বমহিমায় জেগে ওঠার দিন
** নবীর অনুসরণই তার প্রতি ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম প্রতিফলন
** শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ মুজেযা
** পূর্ণাঙ্গ সিরাতের চর্চা না থাকায় তরুণসমাজ সহজে বিভ্রান্ত হচ্ছে
** সিরাত কাকে বলে?
** নবী মুহাম্মদ (সা.) শৈশব ও যৌবনে কেমন ছিলেন
** ফেসবুকে মহানবীর মর্যাদা ও পরিচয় বিষয়ক ক্যাম্পেইন
** নবী মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ
** আল্লাহকে পেতে হলে সুন্নত পালন ও রাসূলকে ভালোবাসতে হবে
** পরিবেশ রক্ষায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পদক্ষেপ ও নির্দেশনা
** স্বাগতম রবিউল আউয়াল মাস