এই বিশ্ব চরাচরে মানুষের জীবনে নানা রকমের দোষ ও গুণে সমাবেশ দেখা যায়। কোনো কোনো মানুষের গুণ থাকে কম, দোষ থাকে বেশি।
নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য চূড়ান্ত আদর্শ। প্রায় দেঢ় হাজার বছর পূর্বে তিনি আগমন করেন। ওই সময় থেকে শুরু করে পৃথিবীর অস্তিত্বের সর্বশেষ দিন পর্যন্ত আর কোনো নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। এই দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীবাসীর জীবন গড়ার জন্য সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছে নবীর জীবন।
একটি দু’টি করে গুণতে গেলে আল্লাহর রাসূলের শত শত গুণের এক দীর্ঘ তালিকা তৈরি হবে। আজ শুধু তার জীবনের জীবনের অনন্য দু’চারটি দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে।
সব মানুষের কল্যাণ কামনায়ই তার আগমন
সব ধরনের মানুষের কল্যাণ কামনা ছিলো নবী করিমের এক অনন্য ও বিশিষ্ট গুণ। তিনি মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। মানুষের অকল্যাণ দেখে তিনি ব্যথিত হতেন। কোনো মানুষ আল্লাহর প্রতি উদাসীন থেকে নিজের জীবন বরবাদ করুক, তা তিনি চাইতেন না। তাই তিনি প্রতিটি মানুষকে আল্লাহর পথে আনার জন্য বারবার তাদের কাছে যেতেন, তাদের সামনে আল্লাহর সঠিক পরিচয় তুলে ধরতেন এবং আল্লাহর পথে এগিয়ে আসার জন্য তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাতেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই- কল্যাণকামী বন্ধু।
দুঃস্থ মানবতার প্রতি দরদ উতলে উঠত
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব দরদী ব্যক্তিত্ব। সমাজের বঞ্চিত, শোষিত, অত্যাচারিত ও অসহায় মানুষের জন্য তার অন্তর ছিলো সদা ব্যাকুল। আত্মীয়-অনাত্মীয় সব অভাবী মানুষের পাশে তাকে দেখা যেতো। তিনি বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। সম্ভাব্য সব উপায়ে তিনি তাদের বিপদমুক্ত করার চেষ্টা চালাতেন। অত্যাচারী মনিবের হাত থেকে ক্রীতদাসদের মুক্তির জন্য তিনি অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। ঋণভারে যাদের নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দিতো তাদের ঋণমুক্ত করার জন্য তিনি সাহায্যের হাত বাড়াতেন।
কারো অসুখের খবর পেলে তিনি তার কাছে হাজির হতেন, তাকে সান্ত্বনা দিতেন এবং তার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছেন, কিন্তু সেই অর্থের সিংহভাগ তিনি পরার্থে বিলিয়ে দিয়েছেন। কোনো অভাবী মানুষ হাত পেতে তার নিকট থেকে খালি হাতে ফিরে যেতো না। অভুক্তকে আহার করিয়ে তিনি দারুণ তৃষ্টি পেতেন।
সবার সঙ্গে সদাচরণের উত্তম নমুনা
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সদাচরণের বিমূর্ত রূপ। তিনি হাসিমাখা মুখে লোকদের সঙ্গে আলাপ করতেন। তিনি গভীরভাবে স্ত্রীদের ভালোবাসতেন। তাদের সঙ্গে প্রাণখুলে আলাপ করতেন, হাসিতামাশা করতেন। সন্তানদেরও খুব স্নেহ করতেন। যে কোনো শিশুকে দেখলে তিনি আদর করতেন। চাকর-বাকররা নানাবিধ কাজে তার সাহায্যকারী ছিলো বিধায়- তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাতেন। কোনোদিন তিনি কোনো চাকরকে মারেননি, কোনোদিন কাউকে বকেননি। কোনো আত্মীয়-স্বজন তার ব্যবহারে কখনো আঘাত পায়নি। পড়শীদের সঙ্গে তিনি কখনো বিবাদ করেননি।
নতুন ধর্মের প্রবক্তা ও নেতা হিসেবে প্রতিনিয়ত তাকে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা ও আলাপ-আলোচনা করতে হতো। কিন্তু তিনি কোনোদিন ধৈর্য হারাননি, বিরক্ত হয়ে কারো প্রতি রূঢ় আচরণ করেননি। তিনি যখন রাষ্ট্রপ্রধান হলেন তখন তার ব্যস্ততা বেড়ে গেল শতগুণ। তখনো কিন্তু সেই শান্ত, ধৈর্যশীল ও সদালাপী মানুষটির মেজাজে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধি দল আসতো তার কাছে, আসতো বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদের দূতরাও। সবাই তার মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হতো।
কথার অনুরূপ কাজ ছিলো তার ভূষণ
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজের মাঝে ছিলো অপূর্ব মিল। তিনি এমন কোনো কথা বলতেন না যা নিজে করতেন না। তিনি লোকদেরকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথা বলতেন, রমজানের রোজার নির্দেশ দিতেন। লোকদেরকে তাদের সম্পদের একটি অংশ আল্লাহর পথে দান করতে উৎসাহিত করতেন। সাহাবি আবু যর গিফারী (রা.) বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহর সঙ্গে হাঁটছিলাম। পথে তিনি বললেন, ‘ওহে আবু যর! উহুদ পাহাড়টি যদি আমার জন্য সোনায় পরিণত হতো, তিন রাত পর তার একটি দিনার পরিমাণও আমার নিকট থাকুক তা আমি পছন্দ করবো না। ’
তিনি লোকদেরকে অল্পে তুষ্ট থাকার জন্য বলতেন। তিনি বলতেন, ‘আদম সন্তানের এই কয়েকটি বস্তু ছাড়া আর কিছুরই অধিকার নেই, বসবাসের জন্য একটি ঘর, লজ্জা নিবারণের জন্য একটু কাপড় এবং ক্ষুধা মেটানোর জন্য শুকনো রুটি ও পানি। ’
মহানুভবতায় তার দৃষ্টান্ত তিনিই
শেষ নবীর ছিলো মহাকাশের মতো উদার এক হৃদয়। তিনি ছিলেন পরম ক্ষমাশীল। আল্লাহর রাসূলকে অনেক গালি দেয়া হয়েছে। তার চরিত্র হননের লক্ষ্যে আজেবাজে কবিতা রচনা করে লোকদেরকে শুনানো হয়েছে। তার মুখে ও মাথায় ধুলি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। নামাজের সময় তার পিঠে ঘাড়ে উটের নাড়িভুঁড়ি তুলে দেয়া হয়েছে। ঘরের দরজায় আবর্জনা ফেলা হয়েছে। ঘরের চালে ঢিল মারা হয়েছে। গলায় কাপড়ের ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
নবীর জনসমাবেশে হামলা চালিয়ে তাকে আহত করা হয়েছে। তিন বছর একটি গিরিসঙ্কটে আটক করে রেখে খাদ্য ও পানি সরবরাহ না করে কষ্ট দেয়া হয়েছে। তার অণুগামীদেরকে বেদম প্রহার করা হয়েছে। মরুভূমির গরম বালুতে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তার মেয়েদেরকে তালাক দেয়া হয়েছে।
তিনি মদিনায় চলে গেলে সেখানে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন রণাঙ্গনে তার প্রিয় অনেক সাথীকে হত্যা করা হয়েছে। যারা এসব কর্মকাণ্ডের হোতা তাদের অনেকেই মক্কা বিজয়ের দিন কাবার চত্বরে জড়ো হয়েছিলো। গোটা মক্কা নগরী মুসলমানদের পদানত। সবাই রাসূলের নির্দেশের প্রতীক্ষায়। কিন্তু না, মহাবিজয়ীর কণ্ঠ থেকে ঘোষিত হলো- ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত। ’ মহানুভবতার এমন উদাহরণ আর কোথাও আছে কি?
বস্তুত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব চরিত্রের পূর্ণত্বের প্রতীক। জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে তার উপস্থাপিত উদাহরণ অনন্য ও সর্বোত্তম। আর সেই জন্যই তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য উত্তম আদর্শ। আর তার অাদর্শের অনুসরণেই রয়েছে মুক্তি ও সফলতা।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৫
এমএ/
** নবীর ওপর বেশি বেশি দরুদ পড়ুন, মনে শান্তি পাবেন
** সিরাতে ইবনে কাসির: সিরাত শাস্ত্রের বিশুদ্ধতম গ্রন্থ
** সিরাতে ইবনে হিশাম: অনবদ্য এক সিরাত গ্রন্থ
** সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেযা নিয়ে কিছু কথা
** ইতিহাসের প্রথম সিরাতগ্রন্থ
** মুসলমানদের স্বমহিমায় জেগে ওঠার দিন
** নবীর অনুসরণই তার প্রতি ভালোবাসার শ্রেষ্ঠতম প্রতিফলন
** শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ মুজেযা
** পূর্ণাঙ্গ সিরাতের চর্চা না থাকায় তরুণসমাজ সহজে বিভ্রান্ত হচ্ছে
** সিরাত কাকে বলে?
** নবী মুহাম্মদ (সা.) শৈশব ও যৌবনে কেমন ছিলেন
** ফেসবুকে মহানবীর মর্যাদা ও পরিচয় বিষয়ক ক্যাম্পেইন
** নবী মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ
** আল্লাহকে পেতে হলে সুন্নত পালন ও রাসূলকে ভালোবাসতে হবে
** পরিবেশ রক্ষায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পদক্ষেপ ও নির্দেশনা
** স্বাগতম রবিউল আউয়াল মাস